তাপসী রাজধানীর মিরপুরে ন্যামভবন ফুটপাতে চা বেচেন। তার মাসে আয় ১৫ থেকে ১৭ হাজার টাকা।
একই স্থানে বাসস্ট্যান্ডে বাসের অপেক্ষায় আছেন রাহিদা আক্তার। তিনি চাকরি করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। আটটার আগে তাকে অফিসে পৌঁছতে হবে।
রোজ সকালের আরেক কর্মজীবি নারী জাকিয়া সুলতানা। যিনি সকাল সাতটা হতেই সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে ছেলেকে নিয়ে বের হয়েছেন প্রাইভেট পড়ানোর জন্য। যে করেই হোক সাড়ে সাতটার মধ্যে শিক্ষকের কাছে পৌঁছুতে হবে।
কাজের তাগিদে এ ছুটে চলা এসব নারীর রোজনামচা।
তাপসীর তিন সন্তানের মধ্যে মেঝোজনের বয়স আট। এই মেয়ের জন্মের সময় চাকরি ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যান। এরপর ঢাকায় ফিরে চাকরি পাওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।
স্বামী একটি কারখানায় চাকরি করতেন। তার রোজগারই ছিল ভরসা। যদিও তাতে সংসার চলছিল না। বাধ্য হয়ে ফ্লাস্কে চা নিয়ে বিক্রির জন্য বের হন। কিছুদিন পর স্বামীর চাকরিটা চলে যায়। সেই থেকে তাপসীর চা বিক্রির পয়সায় চলছে সংসার।
শুক্রবার (৯ ডিসেম্বর) সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে যখন সূর্যমূখীর মতো এসব নারী নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছেন, তখন দেশজুড়ে পালিত হচ্ছে উপমহাদেশের নারী জাগরণের পথিকৃত বেগম রোকেয়া স্মরণে ‘রোকেয়া দিবস’।
যিনি নারীর ‘অবরোধবাসিনীর’ শৃঙ্খলা ভেঙে মানুষের মর্যাদার গান শুনিয়েছিলেন। নারীকে জীবন, সংসার তথ্য সমাজের অনিবার্য অংশ হওয়ার সাহসী উচ্চারণ শিখিয়েছিলেন।
এই জন্মদিনে রাহেজা বা জাকিয়া সুলতানা বেগম রোকেয়ার নারী জাগরণের কথা বইয়ে পড়লেও রংপুরের নারী তাপসী কোনোদিনই শোনেননি।
কিন্তু জীবন ও জীবিকার তাগিদে বেগম রোকেয়ার সূচিত যুদ্ধের ময়দানেরই তারা একেকজন অচলায়তনভাঙা অদম্য যোদ্ধা।
নারী নেতৃবৃন্দ বলছেন, আজ নারী শুধু জীবন ধারণ বা বেঁচে থাকার জন্য কর্মস্থলে নয়, দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে দক্ষতার ও যোগ্যতার দায়িত্ব পালন করছেন। নীতিনির্ধারণ থেকে শুরু করে শান্তি রক্ষা ও সেনাবাহিনীতে সবখানেই নারীদের বিচরণ।
এমন একজন সফল নারী অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব শরিফা খান, যিনি দক্ষতা ও যোগ্যতার সঙ্গে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি দেশের বাইরেও সরকারের মিশনে বিভিন্ন সময় নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এক সময় কোন নারীর রাস্তায় বের হওয়ার সুযোগ ছিল না। পর্দার আড়ালে থাকতে হতো। সেই সময় বেগম রোকেয়া নারীকে ঘরের বাইরের বের করে আনার চেষ্টা করেন। তিনি নিজেসহ নারীদের শিক্ষায় মনোনিবেশ করান। গোটা নারী সমাজে শিক্ষার আলো জ্বালিয়েছেন বেগম রোকেয়া। তিনি যে আলো জ্বালিয়ে দিয়েছেন সেই আলো নিভে যায়নি। দিনের পর দিন উজ্জ্বলতা আরও বাড়ছে ।
শরিফা খান বলেন, সেই আলোকে আজকে আরও উজ্জ্বল করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক সময় নারীকে যেখানে কেউ চিন্তা করতে পারতেন না। আজকে তিনি নারীকে দায়িত্ব দিচ্ছেন। এটা কিন্তু বেগম রোকেয়ার নির্দেশিত পথ ধরেই। সেটা আজ তিনি বেগবান করেছে। আগামীতে এই ধারা আরও বেগবান হবে।
তিনি উল্লেখ করেন, নারীকে যোগ্যতা দিয়ে বিচার করা হবে, জেন্ডার দিয়ে নয়। সেই যোগ্যতা দিয়ে শিক্ষাজীবন, কর্মজীবনে টিকে থাকবে। সব চ্যালেঞ্জিং কাজে নারীদের আরও দেখতে চাই।
ব্যবসা-বাণিজ্য ও উদ্যোক্তা হিসেবেও এগিয়ে যাচ্ছেন নারী । বিগত ১০ বছরে নারী উদ্যোক্তার হার বেড়েছে প্রায় ১২৬ শতাংশ।
সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে নিবন্ধন করেছে,পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২৯১৯-২০ অর্থবছরে পাইকারি ও খুচরা প্রতিষ্ঠান ছিল ২৫ লাখ ৪০ হাজার ৮৯৭টি। এ প্রতিষ্ঠানে নারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ ৩ হাজার ১৮৯জন। আর পুরুষের সংখ্যা ১ কোটি ৩৯ লাখ ১ হাজার ৫৬৪ জন। ১০ বছর আগে ১০০৯-১০ অর্থবছরে নারীর এ সংখ্যা ছিল মাত্র ৮৯ হাজার ৮৪৮ জন।
সরকারের দপ্তরে নিবন্ধন করে না, এমন নারীর হার আরও বেশি। যারা স্বনিয়োজিত ও অন্যপ্রতিষ্ঠানে কর্মজীবী হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। গ্রামে ও শহরে উভয় জায়গায় এমন রয়েছে। নারীর বিকাশে অনিবন্ধিত কর্মজীবী নারীর সংখ্যাই বেশি যারা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছেন।
দেশের শিল্প কারখানাতে নারী পুরুষের সংখ্যাকে অতিক্রম করে গেছে। এ খাতে নারীর অংশগ্রহণ ৫৪ শতাংশ। আর শতভাগ রপ্তানিমূখী তৈরি পোশাক শিল্পে নারীর অংশগ্রহণ দুই তৃতীয়ংশের বেশি।
সরকারি চাকরিতে নারীর অংশগ্রহণ ২৭ শতাংশ, প্রাথমিক শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ ৬৫ শতাংশ। আর চা-শিল্পের দুই তৃতীয়াংশ শ্রমিক নারী।
দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও নারী শ্রমিক কর্মরত। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বেশি আলোচিত বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চায়ন ও প্রবাসী আয়ের অন্যতম যোগানদাতা নারী প্রবাসী শ্রমিক। প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ প্রবাসী শ্রমিকের মধ্যে নারীর সংখ্যা প্রায় এক লাখ ২৫ হাজার।
নারীর এই অগ্রগতি নারীর প্রয়োজনে এসেছে। তবে তাতে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যেমনটা বলছেন সচিব শরীফা খান।
এ বিষয়ে আরও খানিক এগিয়ে বললেন গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, প্রচলিত দার্শনিক যে ব্যাখ্যা বাংলাদেশের নারী জাগরণ তাকেও ছাড়িয়ে গেছে। কার্ল মার্কসের ‘যখন মেশিনারীজ উন্নত হবে ,শারীরিক কসরত কমে যাবে।
তখন ব্যাপক মাত্রায় নারী ও শিশুদের বের করে আনবে উদ্ধৃত করে জলি তালুকদার বলেন, সেই প্রশ্নে পুঁজিপতিরা তাদের শ্রম শোষনের জন্য নারীদের বের করে আনেনি। বরং নারীরা এমনিতেই তাদের জীবনের প্রয়োজনে বের হয়ে এসেছে।
এ ক্ষেত্রে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায়, রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এবং বিরাজমান ধনবাদী পরিস্থিতির মধ্যেও শ্রমজীবি নারীরা বিরাট ভূমিকা পালন করছেন। নারীরা রাষ্ট্র থেকে শুরু করে সমাজ এবং পরিবার সর্বক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে পেরেছেন।
বেগম রোকেয়াকে স্মরণ করে এই নারী শ্রমিকনেত্রী বলেন, তিনি বাঙালী নারী জাগরনের অগ্রদূত। বেগম রোকেয়া যে সময়ে লড়াই করেছন সে সময়ে নারীদের অবস্থা আরও ভয়ঙ্কর ছিল। নারীর চলার ক্ষেত্র একেবারেই সংকুচিত ছিল। লেখা ও কর্মের মধ্যে দিয়ে লড়াই করেছেন। তিনি কয়েকশ’ বছর ধরে নারী জাগরণের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন এবং রাখবেন।
তিনি বলেন, নারীমুক্তির ক্ষেত্রে গার্মেন্টস শ্রমিকরা আরেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। চা ও ট্যানারি শ্রমিকসহ বেশ কিছু খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
আবার অনেক ক্ষেত্রেই নারীরা প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছেন। এখনও নারীরা রাস্তাঘাট, গণপরিবহনে নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। তারপরও নারীদের চলার ক্ষেত্রে কিছুটা সুগম করেছে। এর মধ্যে দিয়েই এগিয়ে যাচ্ছেন নারীরা।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘণ্ট, ডিসেম্বর ০৯ , ২০২২
জেডএ/এসএএইচ