ফেনী: ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার মুহুরী নদীর উপর ইট-লোহা-সিমেন্টের যে অবকাঠামোটি দাঁড়িয়ে আছে তার নাম মহামায়া সেতু।
একে শুধুই একটি সেতু বললেও স্থানীয়দের কাছে তা কেবলই সেতু নয়; চার লাখের বেশি মানুষের স্বপ্নের বাস্তবায়ন।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম নদীর উপর একটি সেতুর স্বপ্ন দেখে বেড়ে উঠেছে। সবাই ভাবতো তাদের একটি সেতু হবে যাতায়াত হবে ভোগান্তিহীন নির্বিঘ্নে।
নদীর এপাড়ের সঙ্গে ওপাড়ের মানুষের আত্মীয়তার সম্পর্ক হতো না, ইচ্ছে থাকলেও মেলবন্ধন হতো না। আর ৯০ মিটারের সেতুটি যেন হাজার বছরের দূরত্বকে ঘুছিয়ে দিলো। আর সেকারণেই প্রাণের উচ্ছ্বাস দুই পাড়ের মানুষের।
সেতুটির উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখা সেই আবেগ- উচ্ছ্বাস। তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে সভা চলছে। মঞ্চে বক্তারা বক্তব্য দিচ্ছিলেন। দর্শক সারির একদম শেষ প্রান্তে সেতুর একটু আগের চেয়ারটিতে বসে গভীর মনোযোগ হয়ে বক্তব্য শুনছিলেন ষাটোর্ধ একজন।
প্রশ্ন করলাম তাকে, এই যে সেতুটি হলো- আপনাদের কেমন উপকার হলো। কাজী জাফর আহম্মদ মজুমদার নামের স্থানীয় সেই প্রবীণ ব্যক্তি এক কথায় জানালেন, ‘যেন দুই বাংলা এক হলো’।
ব্যাখা জানতে চাইলে তিনি জানালেন নদীর পূর্ব পাশে মহামায়া ইউনিয়েনের মাটিয়াগোদা গ্রাম পশ্চিম পাশে পাঠান নগর ইউনিয়নের গতিয়া সোনাপুর ও ফুলগাজীর শ্রী চন্দ্রপুর। কাছাকাছি জনপদ হলেও এক গ্রামের সঙ্গে আরেক গ্রামের ছেলে-মেয়ের বিয়ে হতো না। আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরি করতে মানুষ ভয় পেতো। কারণ একটাই নদী পার হওয়ার অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। শত বছরের সেই দুর্ভোগ যাত্রা ঘুছে দিলো এই সেতু। এখন মানুষ নিমিষেই নদী পার হচ্ছে। যেন দুই বাংলা এক হলো। চার লাখের বেশি মানুষের মনে আশা পূরণ হলো।
ওবায়দুল হক মেস্তরী নামের আরেক স্থানীয় জানায়, এক সময় কলার ভেউরা দিয়ে লগি মেরে নদী পার হওয়া লাগত। এরপর নৌকা হলো। সর্বশেষ বঙ্গবন্ধু কন্যার সরকার সেতু করে দিলো। মাশাআল্লাহ এখন আর আমাদের কোনো দুর্ভোগ নেই।
স্থানীয় বাসিন্দা সাংবাদিক ও সংগঠক এবিএম নিজাম উদ্দিন বলেন। যুগ যুগ ধরে এ অঞ্চলের মানুষ অবহেলিত ছিলো। মহামায়া ঘাটে মুহুরী নদীর ওপর সেতু না থাকায় যুগের পর যুগ এলাকার মানুষের চলাচলের জন্য সহজ কোন মাধ্যম ছিলো না। যার ফলে মানুষের দুর্ভোগ আর ভোগান্তির মধ্যে দিন কাটাতে হতো। দুর্ভোগের সেই যুগের অবসান হলো। ব্রিজটি এলাকার মানুষের স্বপ্ন ছিলো। বাস্তবায়ন হওয়ার পুরো এলাকার দৃশ্যপট পাল্টে গেছে।
সেতুসংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা এখলাস উদ্দিন খোন্দকার বাবলু বলেন, সেতুর সঙ্গে সড়কও পাকা হলো। বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হলো গ্রাম। পুরো দৃশ্যপট যেন এ সেতুটাই পাল্টে দিলো।
সিরাজুল ইসলাম নামের আরেক স্থানীয় জানায়, একসময় চার আনা দিয়ে নৌকা পার হতাম, সর্বশেষ নৌকায় ১০ টাকা দিয়ে পার হওয়া লাগতো। এখন নিমিষেই নদী পার হচ্ছি। ফেনী- ছাগলনাইয়া যেখানেই ইচ্ছে চলে যাচ্ছি।
জেলার ছাগলনাইয়া ও ফুলগাজী উপজেলার মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে মুহুরী নদীর উপর সংযোগস্থল মহামায়াঘাট সেতুটি নির্মাণ করা হয়। স্থানীয়রা জানায়, কালের বিবর্তনে এ অঞ্চলের হাজার হাজার পেশাজীবী মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন নৌকায় মহামায়াঘাট পার হয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো। স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই এলাকাবাসী ছাগলনাইয়া ও ফুলগাজী উপজেলার সংযোগস্থল মুহুরী নদীর উপর মহামায়াঘাট সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছিলেন।
অবহেলিত এ দুই অঞ্চলের মানুষের শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা ও দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে মানুষের চলাচলের জন্য মহামায়া ঘাটে সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেন ফেনী-১ আসনের সংসদ সদস্য শিরিন আখতার এবং ছাগলনাইয়া উপজেলা চেয়ারম্যান মেজবাউল হায়দার চৌধুরী সোহেল। ৭ কোটি ২৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ৯০ মিটার লম্বা ও ৫.৫০ মিটার প্রসস্থ এ সেতুটি নির্মাণে সম্ভাবনার দুয়ার খুলে গেছে। আর্থ-সামাজিক দিক দিয়ে এসেছে বিস্তর পরিবর্তন। সেতুটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিলো ২০১৮ সালে ৬ই অক্টোবর।
সেতুটির নির্মাণের বিষয়ে ফেনী -১ আসনের সংসদ সদস্য ও জাসদের (ইনু) কেন্দ্রিয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার বলেন, খালেদা জিয়া এ সংসদীয় আসন থেকে বারবার নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাকে যারা ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছিলেন সেই মানুষগুলো এখানে একটা সেতুর জন্য বারবার গিয়েছিলেন। কেঁদে চোখের পানিও ছেড়েছিলেন কিন্তু খালেদার মন গলেনি। এখানে একটি সেতু তারা করে দেয়নি।
শিরিন আখতার বলেন, নদী পাড়ে পরিদর্শনে এসে স্থানীয়দের কথা দিয়েছিলাম একদিন নদীর উপর সেতু দিয়ে হেঁটে এসে আপনাদের সঙ্গে কথা বলে যাব, আপনাদের দেখে যাব। সেই কথা রাখতে পেরেছি। এ সেতুটি ছিলো এ অঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন। তাদের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পেরে অন্যরকম ভাল লাগা কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কারণে দেশব্যাপী যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।
মুহুরী নদীর দুই পাড়ে ধান, সরিষাসহ বিভিন্ন ডাল ও শাক সবজি এতদিন নৌকা করে পারাপার করতে হতো। নদীর কারণে দীর্ঘ পথ ঘুরে চাঁদগাজী বাজার হয়ে ছাগলনাইয়া নেওয়া হতো উৎপাদিত পণ্য। এখন আর তা করা লাগবে না। খুব সহজেই এসব কৃষি পণ্য এখন পরিবহন করা যাবে। ছাগলনাইয়া, ফেনী, বাংলাবাজার, ফুলগাজী কিংবা চাঁদগাজী যেদিকে ইচ্ছে নেয়া যাবে কৃষি পণ্য। এতে কৃষি পণ্য পরিবহণ খরচ কমে এসেছে বহুলাংশে।
স্থানীয় মাটিয়াগোদা গ্রামের রবিউল হক রফিক নামের একজন জানান, আগে ফসল উৎপাদন করলে চাঁদগাচী ঘুরে ছাগলনাইয়া যেতে হতো। এখন ব্রিজ হওয়ায় সরাসরি ফেনী চলে যাওয়া যায়।
মোতাহের হোসেন মিন্টু নামের আরেকজন জানান, আগে বাজারে ধান নেয়া যেতা না, আনা যেতো না। এখন চাইলেই ছাগলনাইয়া চলে যাওযা যায়। চাইলেই বাংলাবাজার হয়ে ফেনী চলে যাওযা যায়।
গ্রামের এই বাসিন্দা জানান, সেতুটি হওয়ার পর জমির দামও আগে থেকে বাড়ছে। মানুষের যাতায়াত সহজ হওয়ায় আনাগোনা বেড়েছে।
ছাগলনাইয়া উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক মেজবাউল হায়দার চৌধুরী সোহেল বলেন, মুহুরী নদীর উপর সেতু নির্মাণ ছিল এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি। শেখ হাসিনার সরকার দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমুল পরিবর্তন করেছেন। এ সেতুটি নির্মাণের ফলে ওই অঞ্চলের মানুষের জীবন যাত্রার মান অনেক উন্নত হবে।
এ সেতু শুধু আর্থ সামাজিক ভূমিকাই রাখছে না। এ সেতু এবং নদী পাড়ের প্রকৃতি দেখার জন্য প্রতিদিন জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আসছেন। নৌকায় ঘুরছেন। ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন। বলা যায় সেতুটি দর্শনীয় স্থান হিসেবেও পরিচিতি পাচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দা ও ছাগলনাইয়া সরকারি কলেজের স্নাতকের শিক্ষার্থী রফিকুল ইসলাম বলেন, এই সেতুটি না থাকায় কি পরিমাণ কষ্ট আমরা করেছি তা একমাত্র আমরাই জানি। সেতুর অভাবে শিক্ষার্থীদেরও চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা নদী পার হয়ে প্রতিদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতায়াত করতো। এখন আর সেই কষ্ট হবে না।
রফিক জানায়, সেতুটির কারণে তাদের পুরো এলাকাটি আলোকিত হয়ে গেছে। স্থানীয় আরো বেশ কয়েকজন জানায় স্বপ্ন পূরণ হতে যাওয়া সেতুটিকে ঘিরে ২ উপজেলার প্রায় ৪ লাখ মানুষের মধ্যে এখন বইছে আনন্দের জোয়ার বইছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০২২
এসএইচডি/এসএএইচ