ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

জেলে পরিবার থেকে পরমাণু বিজ্ঞানী শাবিপ্রবির প্রমোদ বৈদ্য

হাসান নাঈম, শাবিপ্রবি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৬ ঘণ্টা, জুন ১২, ২০২৩
জেলে পরিবার থেকে পরমাণু বিজ্ঞানী শাবিপ্রবির প্রমোদ বৈদ্য প্রমোদ বৈদ্য

শাবিপ্রবি (সিলেট): প্রত্যন্ত অঞ্চলের জেলে পরিবার থেকে উঠে এসে পরমাণু বিজ্ঞানী হয়েছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) সাবেক শিক্ষার্থী প্রমোদ চন্দ্র বৈদ্য। বর্তমানে তিনি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিউট্রন-ফিজিক্যাল ক্যালকুলেশন অ্যান্ড মেজারমেন্ট নিয়ে কাজ করছেন।

 

প্রমোদ শাবিপ্রবির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৩-১৪ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। এছাড়া চলতি বছর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) কর্তৃক ‘প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক-১৯ এর জন্যও মনোনীত হয়েছেন তিনি।

পরমাণু বিজ্ঞানী হওয়ার পেছনের গল্প নিয়ে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা হয় প্রমোদ চন্দ্র বৈদ্যের।

প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক পাওয়ার অনুভূতি জানিয়ে প্রমোদ বলেন, আমি শাবিপ্রবির ভৌতবিজ্ঞান অনুষদে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে সর্বোচ্চ সিজিপিএ-৩.৯২ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক-১৯ এর জন্য মনোনীত হয়েছি। এটি আমার জীবনে একটি বড় পাওয়া। এই কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্য আমার মা-বাবা, পরিবার, মামা এবং এলাকাবাসীর অনেক সহযোগিতা ছিল, এজন্য তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

পরমাণু বিজ্ঞানী হওয়ার পেছনের গল্প নিয়ে তিবি বলেন, আমার বাবা পেশায় একজন জেলে। তিনি নদীতে মাছ ধরে আমাদের সংসার চালাতেন। বাবা বেল জাল (গ্রাম্য ভাষায়) দিয়ে নদীতে মাছ ধরতেন, আমি বাবার সঙ্গে সঙ্গে থাকতাম (নৌকায়)। তবে হতাশার বিষয় ছিল বর্ষাকালে মাছ পাওয়া গেলেও শুকনো মৌসুমে মাছ একদমই পাওয়া যেত না। ফলে বছরের বাকি সময়গুলো খুবই অভাব-অনটনের মধ্যে দিয়ে কাটাতে হত।  

পরিবারের দুরাবস্থার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমার বাড়ি থেকে স্কুল (প্রাথমিক) দূরে হওয়ায় প্রতিদিন আসা-যাওয়া করতে অনেক কষ্ট হত। একদিকে স্কুল, অন্যদিকে বাবার কাজে সময় দেওয়া। দুইটা আমার জন্য কঠিন হয়ে উঠেছিল। ফলে অনেক সময় স্কুল মিস যেত। এমন পরিস্থিতিতে একবার আমার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। তখন বাবার আয় না থাকায় ঋণ করে আমাদের সংসার চলতো। পরে পরিবার থেকে সিদ্ধান্ত হয় পড়াশোনা বন্ধ করে বাবার কাজে সঙ্গ দিতে। শৈশব এবং ‍কিশোর জীবন আমার সেভাবে কেটে যায়।

পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কিছুদিন পর আমার শিক্ষকদের সহযোগিতায় পুনরায় লেখাপড়া শুরু করি। পঞ্চম শ্রেণিতে থাকাকালীন একবার চাল বিক্রি করে আমার পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন করতে হয়েছিল। সেটাই ছিল আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট।  

এরপর স্কুলের প্রথম শিক্ষার্থী হিসেবে থানায় পঞ্চম স্থান অধিকার করে প্রাথমিকে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাই। তারপর ২০১১ সালে কুমিল্লা বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়ে মেধা তালিকায় স্থান করে নিই। এরপর ২০১৩ সালে নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে শাবিপ্রবিতে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই। স্কুল জীবন থেকেই পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে আমার আগ্রহ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর আগ্রহটা আরও বেড়ে যায়। তবে নিউক্লিয়ার ফিজিক্স অংশ আমার সবচেয়ে বেশি ইন্টারেস্টিং ও আগ্রহের জায়গা ছিল।

পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেকে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কথা বললে চেরনোবিল বা ফুকুশিমার কথা ভেবে ভয় পায়। আমি মনে করি, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র মানবকল্যাণে পদার্থবিজ্ঞানের বড় একটি অবদান। এটি ততক্ষণ মানবকল্যাণ বয়ে আনবে, যতক্ষণ পর্যন্ত এর সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে। এ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পদার্থবিজ্ঞান চর্চা অনস্বীকার্য। তাই নিজের অর্জিত জ্ঞানকে দেশের কল্যাণে কাজে লাগাতে রূপপুরে পরমাণু বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ শুরু করি।

তরুণ এ বিজ্ঞানী বলেন, পারমাণবিক সুরক্ষার জ্ঞানকে আরও শানিত করতে আমি রাশিয়ান ফেডারেশন থেকে দুই ধাপে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়েছি। এতে রাশিয়ায় কুরচাতভ ইনস্টিটিউট, রোসাটম টেকনিক্যাল একাডেমি, নভোভরোনেজ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিই। বর্তমানে আমি রূপপুরে নিউক্লিয়ার সেফটি অ্যান্ড রিলায়েবিলিটি ডিপার্টমেন্টের অধীনে নিউট্রন-ফিজিক্যাল ক্যালকুলেশন অ্যান্ড মেজারমেন্ট নিয়ে কাজ করছি। সে প্রশিক্ষণগুলোকে কাজে লাগিয়ে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রকে নিরাপদ রাখতে চাই।

তরুণ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, অনেক শিক্ষার্থী মনে করে বাংলাদেশে মেধার মূল্যায়ন নেই, মেধা দিয়ে কাজ করা যায় না। ফলে অনেকে বিদেশের উন্নত পথ বেছে নেয়। আমি মনে করি, যেখানে যত সমস্যা, সেখানে তত কাজ করার সুযোগ আছে। আমার নিজের ওপরও সে আত্মবিশ্বাস ছিল। তাই বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে মেধাবী শিক্ষার্থীদের এগিয়ে আসতে হবে।

প্রসঙ্গত, প্রমোদ চন্দ্র বৈদ্য চাঁদপুর জেলার মতলব দক্ষিণ থানার উপাদী গ্রামের মাধব চন্দ্র বৈদ্যের সন্তান। তিনি পরিবারের চার ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয়। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি বিতার্কিক সংগঠন, বিজ্ঞান ক্লাব, সাহিত্য সংসদ, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কিনসহ বিভিন্ন সেবামূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেন তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৫২ ঘণ্টা, জুন ১২, ২০২৩

আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।