ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

কুরিয়ার সার্ভিস থেকে দিত ইট, চাকরি দিতে নিত খালি চেক!

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩৮ ঘণ্টা, জুন ১৭, ২০২৩
কুরিয়ার সার্ভিস থেকে দিত ইট, চাকরি দিতে নিত খালি চেক!

ঢাকা: গ্রাহকের সেবা দেওয়ার কথা এজেআর কুরিয়ার সার্ভিসের। কিন্তু তা না করে প্রতিষ্ঠানটি লিপ্ত প্রতারণায়।

তাদের কাছে যারা পণ্য পরিবহনে জন্য অর্ডার করেন, তারা সঠিক বস্তুটি পান না। শুধু তাই নয়, এজেআর’র বিরুদ্ধে আছে স্বত্বাধিকারী সামসু উদ্দিন রিয়াদের বিরুদ্ধে আছে সরকারি সিল-স্বাক্ষর জালিয়াতি ও ৫ কোটি টাকার বেশি ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ। এ সংক্রান্ত মামলার আসামিও তিনি। এমনকি তিনি চাকরি দিতেন প্রত্যাশীদের কাছ থেকে খালি চেক ও স্ট্যাম্প নিয়ে।

সম্প্রতি এক গ্রাহক ঢাকা থেকে একটি মোবাইল চট্টগ্রাম পাঠাতে এজেআর কুরিয়ার সার্ভিসের সেবা নেন। কিন্তু গ্রাহককে মোবাইলের পরিবর্তে ইট দেয় চট্টগ্রামের এজেআর কুরিয়ার সার্ভিস শাখা। পরবর্তীতে ওই গ্রাহক চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অধীন (সিএমপি) কোতোয়ালী থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। তারপরই উঠে আসে এজেআর’র অভিনব প্রতারণার বিষয়টি।

পুলিশ অভিযোগ পাওয়ার পর তদন্ত করে। তারা একটি সিসিটিভি ফুটেজও সংগ্রহ করে, যেখানে দেখা যায় কীভাবে মোবাইলের বাক্সে ইট দেওয়া হয়। এ ঘটনায় এজেআর কুরিয়ার সার্ভিসের চট্টগ্রাম শাখার ম্যানেজারের যোগসাজস ছিল। তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

কিছুদিন আগে এজেআর কুরিয়ার সার্ভিসের স্বত্বাধিকারী সামসু উদ্দিন রিয়াদতে গ্রেপ্তারের দাবিতে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে সামনে মানববন্ধন করেন বেশকয়েকজন ভুক্তভোগী। এতে অংশ নেওয়াদের সিংহভাগ প্রতিষ্ঠানটিতে চাকরি করতেন। তারাই অভিযোগ করেন- রিয়াদ তাদের সাথে প্রতারণা করেছেন। সরকারি সিল-সই জালিয়াতি ও ৫ কোটি টাকার বেশি ভ্যাট ফাঁকির মূল কারিগর তিনি। এ বিষয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা চলমান।

মানববন্ধকারীরা আরও জানান, চাকরিতে নিয়োগের সময় রিয়াদ প্রত্যাশীদের কাছ থেকে ব্যাংক চেকের খালি পাতা ও স্ট্যাম্প নিয়েছেন। পরে সেই চেকে মোটা অংক লিখে তাদের ব্ল্যাকমেইল করেন। এর মাধ্যমে তিনি বিত্তশালী হয়েছেন। এখন তিনি বিলাসবহুল ল্যান্ড ক্রুজার গাড়িতে চলাচল করেন। গ্রামে শত বিঘা জমির ওপর নির্মাণ করেছেন বিলাসবহুল বাড়ি। শত কোটি টাকার মালিক তিনি।

খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, এজেআর’র স্বত্বাধিকারী রিয়াদ চট্টগ্রামের একটি ট্রান্সপোর্টে কিছুদিন চাকরি করেন। পরে সেখান থেকে ঢাকায় এসে এজেআর ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি খোলেন। পরবর্তীতে এজেআর ট্রান্সপোর্ট পাল্টে হয় এজেআর কুরিয়ার সার্ভিস।

নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার চাঁনপুর গ্রামে রিয়াদের বাড়ি। সেখানকার স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেও রিয়াদের প্রতারণা ও বিত্তশালী হয়ে ওঠার বিষয়টি জানা গেছে। তার প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, এলাকার গরিব-দুখীদের কোনো সাহায্য-সহযোগিতা না করলেও রাজনীতির মাঠে রিয়াদ বেশ উদার। তিনি তার অনুসারীদের পেছনে প্রচুর খরচ করেন। স্থানীয় প্রতিটি রাজনৈতিক অনুষ্ঠানেও মোটা অংকের টাকা দেন। আগামীতে নির্বাচনে দাঁড়ানোর পরিকল্পনাও করছেন তিনি।

ঢাকা-চট্টগ্রামের একাধিক ব্যবসায়ীর অভিযোগ, নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, গ্রাহক হয়রানিসহ গ্রাহকদের মালামাল নষ্টের ঘটনায় তারা এজেআর কুরিয়ার সার্ভিসের বিরুদ্ধে বার বার অভিযোগ করছেন। কিন্তু কোনো প্রতিকার মিলছে না। প্রতিষ্ঠানটির অতীতের নানা অপরাধ, প্রতারণার বেশ কিছু প্রমাণ বাংলানিউজের কাছে আছে।

এজেআর ও রিয়াদের বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন ই-টপ ম্যাট্রেস’র কর্ণধার নাঈম। তিনি বলেন, আমাদের মালামাল পরিবহনের জন্য বেশ কয়েকদিন ধরে এজেআর কুরিয়ারকে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফরিদপুরে আমার ম্যাট্রেস পাঠানোর কথা ছিল। যা এজেআর কুরিয়ারের মাধ্যমে পাঠানো হয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষের অবহেলায় সেটি নষ্ট হয়। সেভাবেই পণ্যটি তারা গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেয়।

আগে যদিও তারা ভালোভাবে গ্রাহকের কাছে পণ্য পৌঁছে দিতেন। কিন্তু গত কয়েকমাস ধরে তাদের সেবার অবনতি ব্যাপক। গত কয়েক অর্ডারে এজেআর আমার কোম্পানির ম্যাট্রেস নষ্ট করেছে। গত ৮ জুন সাভারে একটি ম্যাট্রেস ডেলিভারি করা হয়। সেটির অবস্থা এতটাই খারাপ করে এজেআর, গ্রাহক নিজ অর্থ খরচ করে এমন পণ্য কেনে না। এ বিষয়ে এজেআর অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু কোনো সমাধান পাইনি। রাজবাড়ীর একটি ডেলিভারিতেও তারা একই ঘটনা ঘটায়। এসব আমাদের আবার ফেরত আনাতে হয়েছে। এতে আমাদের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। যেগুলো খারাপ অবস্থায় ফিরিয়ে এনেছি, সেগুলো পরিবর্তন করে কাস্টমারকে আবার দিতে হয়েছে। কিন্তু এজেআর ফের একই কাজে করে।

মিম ম্যাট্রেস অ্যান্ড ফার্নিচার নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানেরও একই অভিযোগ করে। তারা তাদের অভিযোগের বিষয়ে রিয়াদকেও জানায়। কিন্তু তিনি কোনো সুরাহা করেননি।

এসব বিষয়ে এজেআর কুরিয়ার সার্ভিসের স্বত্বাধিকারী সামসু উদ্দিন রিয়াদের সঙ্গে কথা বলতে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। মামলা হওয়ার পর থেকে তিনি পলাতক।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অধীন (সিএমপি) কোতয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুল কবির মোবাইলের বদলে ইট দেওয়ার ঘটনায় মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এ ঘটনায় এজেআর কুরিয়ার সার্ভিস চট্টগ্রাম শাখার জড়িত কর্মীকে গ্রেপ্তারের বিষয়টিও তিনি নিশ্চিত করেন।

রিয়াদের বিরুদ্ধে মামলা ও তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টার বিষয়ে বাংলানিউজকে জানান উত্তরা পূর্ব থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার বাদি আমি নিজেই। মামলার কার্যক্রম চলমান। চলতি বছর ২৪ সেপ্টেম্বর আদালতে এ মামলার হাজিরা রয়েছে। তা ছাড়া আমরা রিয়াদকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

বাংলাদেশ সময়: ঘণ্টা, জুন ১৭, ২০২৩
এমকে/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।