ঢাকা, বুধবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

সহিংসতা-ধর্ষণের শিকার নারীর আশ্রয়ের ঠিকানা শেফালিকা

অপু দত্ত, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৪৭ ঘণ্টা, মার্চ ৮, ২০২৪
সহিংসতা-ধর্ষণের শিকার নারীর আশ্রয়ের ঠিকানা শেফালিকা শেফালিকা ত্রিপুরা

খাগড়াছড়ি: খাগড়াছড়ির গুইমারার সিন্দুকছড়ি এলাকায় ২০০৯ সালের ৮ মার্চ এক নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। সেসময় তার ১০ বছরের এক মেয়ে ছিল।

মা হারা ওই মেয়ের কী হবে, তা নিয়ে যখন সবাই দুশ্চিন্তা করছিলেন, তখন তার আশ্রয়ে এগিয়ে আসেন শেফালিকা ত্রিপুরা।  

শুধু তাই নয়, ওই মেয়েকে মায়ের আদরে স্থানীয় স্কুলে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ান। পরে রাঙ্গামাটির মৌনঘর আবাসিক বিদ্যালয় থেকে এসএসএসি পাস করে সে। সেখান থেকে শেফালিকা ত্রিপুরার বাসায় থেকে খাগড়াছড়ি সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি শেষ করে বর্তমানে ঢাকার লালমাটিয়া মহিলা কলেজে অনার্স শেষ বর্ষে অধ্যয়নরত মেয়েটি।

২০১৮ সালে জেলা সদরের গোলাবাড়ির হেমপাড়ার বাসিন্দা নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক কিশোরীকে (১৪) বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে একটি হোটেলে আটকে মারধর ও ধর্ষণ করা হয়। ওই ঘটনায় মামলা হয়। ভীত-আতঙ্কগ্রস্ত সেই কিশোরীর পাশেও দাঁড়ান শেফালিকা ত্রিপুরা। তারই তত্ত্বাবধানে থাকা ওই মেয়ে এখন রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে।  

শুধু এ দুটি ঘটনাই নয়, নির্যাতিত-নিপীড়িত এমন অনেক শিশু, কিশোরী ও নারী আশ্রয়ের ঠিকানা শেফালিকা। আশ্রয় দিয়েই শেষ নয়, তাদের আইনি সহায়তাসহ নিরাপদ জীবনের জন্য বছরের পর বছর কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। অসচ্ছল পরিবারের অনেক সন্তান তার পরম মমতা পেয়ে পড়াশোনা করছে।  

খাগড়াছড়ি জেলা শহরের খাগড়াপুর এলাকায় শেফালিকার আবাস। যেখানে তার পরিবারের সদস্য ছাড়াও অসহায় অনেক মানুষের ঠাঁই হয়েছে একই ছাদের নিচে। এজন্য গোটা জেলায় এখন অসহায়, নির্যাতিত, নিপীড়িত নারীদের আস্থার নাম শেফালিকা ত্রিপুরা। পরিবার ও সমাজের লাঞ্ছনা-বঞ্চনা নিয়ে যখন সব দরজা বন্ধ হয়ে যায়, তখন শেফালিকা ত্রিপুরার ঘরের দরজা সব সময় থাকে খোলা।

ষাটের দশকে জেলার সীমান্তবর্তী মাটিরাঙ্গা উপজেলার তৈইলাইফাং গ্রামে জন্ম শেফালিকার। ১৯৭৭ সালে জেলার মাটিরাঙ্গার তবলছড়ি কদমতলি উচ্চ বিদ্যালয়ে (টিকে স্কুল) এসএসসি পরীক্ষা দেন তিনি। শিক্ষকতা পেশায় স্বামী অলিন্দ্র ত্রিপুরার বিশেষ আগ্রহে লেখাপড়ার পাশাপাশি সামাজিক কাজকর্মে জড়িয়ে যান। স্বামীর চাকরিসূত্রে ১৯৮৪ সালে জেলার দীঘিনালায় গিয়ে নারীদের নিয়ে প্রথম সমিতি গড়ে তোলেন। নারী ও শিশু বিষয়ক পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের প্রশিক্ষণ ও বিসিকের সেলাই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্ম তৎপরতায় গতি আসে। ১৯৮৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে চলতে থাকা সহিংসতার মধ্যেও সমিতির কার্যক্রম থামেনি। অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে জেলা সদরের খাগড়াপুরে চলে এসে পুনরায় নারীদের সংগঠিত করেন শিফালিকা।  

নিপীড়িত নারীর পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে শেফালিকাকে তাড়িত করেছে তার শৈশব। বাবা গোপাল কৃঞ্চ ত্রিপুরার চাকরিসূত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় যেতে হলেও দুর্গম ওই গ্রামে থাকতেই দেখেছেন নানা সংকট আর সহিংসতার চিত্র। নারীদের নানা নির্যাতনের দৃশ্য খুব কাছ থেকে দেখেন তিনি। নিজ এলাকার কঠিন বাস্তবতার মুখে নারীদের সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে দেখেন শেফালিকা। এই অবর্ণনীয় সমাজচিত্র তাকে নাড়া দেয়। সেখান থেকেই তিনি সহিংসতা-নির্যাতনের শিকার নারীদের জন্য কিছু করার উদ্যোগ নেন।

নিজ এলাকা তো বটেই, দুর দুরান্তের বাড়িতে গিয়েও তিনি খোঁজ নিতে থাকেন সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুদের। পাশে দাঁড়াতে থাকেন তাদের। দীর্ঘ সময় ধরে তার এই সমাজসেবার খবর আর নিজের এলাকায়ই আটকে থাকেনি। এখন জেলার কোথাও কিছু ঘটতেই খবর যায় শেফালিকা ত্রিপুরার কাছে। এলাকার পুলিশ; সাধারণ মানুষ থেকে সংবাদকর্মীরা সবার কাছেই তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। অনেকের কাছে তিনি এখন অধিকার আদায়ের পথিকৃৎ মর্যাদার মানুষ। পার্বত্যাঞ্চলের বাইরেও মানবাধিকার কর্মী হিসেবে সমাদৃত শেফালিকা। যদিও বয়সের ভার কখনো তাকে থামিয়ে দিতে চেয়েছে, কিন্তু তিনি থেমে যাননি। বারবার ভুগলেও কারও ডাকে সাড়া না দিয়ে কখনো থাকেননি।

বর্তমানে পার্বত্য অঞ্চলের মধ্যে শীর্ষ নারী এনজিও খাগড়াপুর মহিলা কল্যাণ সমিতির প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক ও সভানেত্রী এবং উইমেন্স রিসোর্স নেটওয়ার্কের সমন্বয়ক শেফালিকা ত্রিপুরা বলেন, শিক্ষা-দীক্ষাহীনতার মাঝে জুমচাষ করে অভাবের সংসার, বাল্যবিয়ে আর নানা পারিবারিক অশান্তি দেখে তাড়িত হয়েছি। নারীদের কল্যাণের জন্য কিছু করতে পারলে আমার ভালো লাগে। কোথাও নারীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের খবর পেলে আমি চুপ থাকতে পারি না। আমার যতটুকু সামর্থ্য করার চেষ্টা করি। সময়ের সঙ্গে জেলায় আরও অনেক নারীকর্মীই নারীর প্রতি বৈষম্য রোধ ও নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে কাজ করছেন। যা খুবই ভালো দিক।

বর্তমানে শেফালিকা ত্রিপুরার প্রতিষ্ঠিত সংগঠনের কর্মীরা নারী অধিকার, পরিবেশ উন্নয়ন, সামাজিক দ্বন্দ্ব নিরসন ও কাউন্সেলিংসহ নানা বিষয়ে দেশ-বিদেশে প্রচুর প্রশিক্ষণের সুযোগ পান।

জেলার সাংবাদিক মুহাম্মদ আবু দাউদ এই নারী অধিকার কর্মীর বিষয়ে বলেন, নারী ও শিশুর সামগ্রিক অধিকার আদায়ে শেফালিকা ত্রিপুরা একজন অগ্রজ মানুষ। যাকে দেখে অনুপ্রাণিত হওয়া যায়। বিশেষত নিপীড়িত নারীদের আশ্রয় দিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন তিনি। তার অসীম ধৈর্য, সহনশীলতা ও একাগ্রতা রয়েছে। নিজের অসুস্থতার মধ্যেও তিনি তীব্র মানসিক শক্তি নিয়েই নারী অধিকারে কাজ করেন।  

নারী অধিকার রক্ষা ও ক্ষমতায়নে বিশেষ অবদান রাখায় বিভিন্ন সময় নানা পুরস্কার ও সম্মাননাও পেয়েছেন শেফালিকা ত্রিপুরা।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৬ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০২৪
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।