ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

ঘূর্ণিঝড় রিমাল

জাহাজের অপরিশোধিত পানিতে তৃষ্ণা মেটাচ্ছে ঘষিয়াখালীবাসী

এস এস শোহান, ডিস্ট্রিক করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২৮ ঘণ্টা, জুন ৪, ২০২৪
জাহাজের অপরিশোধিত পানিতে তৃষ্ণা মেটাচ্ছে ঘষিয়াখালীবাসী

বাগেরহাট: ঘূর্ণিঝড় রিমাল আঘাত হানার আগে থেকেই জোয়ারের পানি উঠতে শুরু করে নদী বেষ্টিত বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার বহরবুনিয়া ইউনিয়ন জুড়ে। ঝড়ের রাতে পুরো ইউনিয়ন ডুবে যায় তিন পাশের কেওড়া, মানিক ও পানগুছি নদী থেকে উঠে আসা জলোচ্ছ্বাসের পানিতে।

নদী তীরবর্তী ঘষিয়াখালী, ফুলহাতা, বহরবুনিয়া গ্রামের পুরোটাই ডুবে যায় জলোচ্ছ্বাসের পানিতে।

বাগেরহাট শহর থেকে সড়ক পথে রামপাল উপজেলার মল্লিকের বের খেয়া ঘাটের অপরপাশে ঘষিয়াখালী লঞ্চঘাট। খেয়াপার হয়ে লঞ্চঘাট থেকে ওপরে উঠলেই বহরবুনিয়া ইউনিয়নের ঘষিয়াখালী বাজার। বাজারের রাস্তার পাশেই রয়েছে জেলা পরিষদের বিশালাকৃতির এক পুকুর। এই পুকুরের পানি পান ও রান্নার কাজে ব্যবহার করেন স্থানীয়রা। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের লবণ পানিতে প্লাবিত হয়েছে পুকুরটি।

ঝড়ের এক সপ্তাহ পরে সোমবার (৩ জুন) সকালে ঘষিয়াখালী বাজারে গিয়ে দেখা যায়, সুপেয় পানির একমাত্র উৎস সেই পুকুরটির দক্ষিণ দক্ষিণ-পশ্চিম কোনে ১০০ ফুটের বেশি পাড় ভেঙে বিলীন হয়ে গেছে। দক্ষিণপাড়ের মাঝখান দিয়েও প্রায় ৫০ ফুটও ভেঙে বিলীন হয়ে গেছে। পাড়ে থাকা কনক্রিটের পিলারও উপড়ে পড়েছে। ঝড়ের আট দিনেও পুকুরের পাড় মেরামতের তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। কবে নাগাদ পুকুর সংস্কার করা হবে তাও জানেন না স্থানীয়রা।

কথা হয় পুকুর পাড়ে থাকা ঘষিয়াখালী বাজারের ব্যবসায়ী আজাদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ঘষিয়াখালী বাজারের ১৩১টি দোকান ও দুই শতাধিক ব্যবসায়ী রয়েছে। তারা সবাই এই পুকুরের পানি পান ও প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করতেন। ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি ঘষিয়াখালী ও আশপাশ এলাকার অন্তত পাঁচ হাজার মানুষ এই পুকুরের পানি পান করেন। কিন্তু পুকুরের পানি লবণাক্ত হয়ে যাওয়ায় খুব সমস্যায় পড়েছেন তারা।

ঘষিয়াখালী বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি জাহিদুল ইসলাম খলিফা বলেন, ঝড়ের পুকুরটির পাড় ভেঙে যাওয়ার আট দিন পরেও চেয়ারম্যান, জনপ্রতিনিধি বা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কেউ পুকুরটি মেরামতের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। দেখতেও আসেনি কেউ। খুবই পানির কষ্টে আছেন স্থানীয়রা। অতিদ্রুত এই এলাকায় সুপেয় পানি সরবরাহ ও পুকুর মেরামতের দাবি জানাই।

বাজার থেকে একটু পূর্ব দিকে গেলেই মোংলা বন্দরের ঘষিয়াখালী চ্যানেল। লোকালয় দিয়ে হেঁটে চ্যানেলের পাড়ে গেলে চোখে পড়ে এক বিশেষ দৃশ্য। স্থানীয় দুই যুবক ট্রলারে কলস নিয়ে চ্যানেলের মাঝখানে একটি জাহাজের উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন। অনুরোধ করে তাদের সঙ্গে যুক্ত হলাম জাহাজের কাছে যাওয়ার জন্য। যেতে যেতে ট্রলার চালক রবিউল জানালেন, ঝড়ের পর থেকে জাহাজের পানিতেই চলছে তাদের খাবারের কাজ। জাহাজের মাস্টার-নাবিকদের অনুরোধ ও মাঝে মধ্যে উপঢৌকন দিয়ে তারা জাহাজ থেকে পানি নেয়। কয়েক মিনিটে কলস নিয়ে জাহাজে পৌঁছায় রবিউল ও তার সহযোগী। জাহাজে উঠে নাবিকদের অনুমতি সাপেক্ষে জাহাজের রিজার্ভার থেকে পানি ভরলেন কলসে।

এসময় কথা হয় জাহাজের ক্যাপ্টেন শাহজাহানের সঙ্গে। তিনি বলেন, মূলত মেঘনা নদী থেকে রিজার্ভারে পানি ভরে নিয়ে আসেন তারা। তাদের রিজার্ভারে পাঁচ থেকে ছয় হাজার লিটার পানি ধরে। একবারের ট্রিপে সব পানি ব্যবহার হয় না। তাই ঘষিয়াখালী এলাকায় যখন জাহাজ নোঙর করা থাকে তখন স্থানীয়রা কলস নিয়ে আসলে তাদের পানি দেন তারা।

জাহাজ থেকে পানি সংগ্রহ করা যুবক রবিউল বলেন, মোংলা বন্দর ও খুলনা-নওয়াপাড়া এলাকায় যাওয়া-আসা করা জাহাজ যাত্রাপথে চ্যানেলের ঘষিয়াখালী এলাকায় প্রায়ই নোঙর করে। তারা আগেও বিভিন্ন সময় জাহাজ থেকে পানি সংগ্রহ করতেন। তবে ঝড়ের পরে জাহাজের পানিই একমাত্র ভরসা তাদের। এলাকার বেশিরভাগ মানুষ এখন জাহাজ থেকে পানি নেয়। কেউ কেউ বিনামূল্যে নেয়, আবার কেউ ছোট খাট খাদ্য পণ্য যেমন, কচু, তালশ্বাস, সিগারেট ও ছোট মুরগির বাচ্চার বিনিময়েও পানি নেয়। তবে কেউ কেউ লঞ্চে করে বাগেরহাট সদর ও রামপালের সন্ন্যাসী বাজার থেকে বোতলের পানি ক্রয় করে আনে। তবে সে সামর্থ্য এলাকার অধিকাংশ মানুষের নেই।  

শুধু রবিউল নয়, এলাকার অনেক যুবকই এখন অপেক্ষায় থাকেন জাহাজ থেকে পানি সংগ্রহ করার। শুধু ঘষিয়াখালী নয়, বহরবুনিয়া ইউনিয়নের সর্বত্রই সুপেয় পানির তীব্র সংকট। সংকট রয়েছে মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা, মোংলা ও কচুয়া উপজেলার অধিকাংশ এলাকায়।

এদিকে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, বাগেরহাটের তথ্য অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড় রিমালে এ জেলায় ২০ হাজার ২২৬টি সুপেয় পানির উৎস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে নলকূপ, রেইন ওয়াটার হার্বেস্টিং ট্যাংকি, পিএসএফ ও পুকুর রয়েছে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, বাগেরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী জয়ন্ত মল্লিক বলেন, ঝড়ের ফলে জেলার বিপুল পরিমাণ পানির উৎস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। সংকট মেটাতে মোংলা, মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলায় তিনটি ভ্রাম্যমাণ ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট দিয়ে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। যা থেকে প্রতিদিন প্রায় সাত হাজার লিটার পানি পাচ্ছেন দুর্গত মানুষেরা।  

তিনি আরও বলেন, বহরবুনিয়া ইউনিয়নেও তীব্র পানির সংকট রয়েছে। ইউনিয়নটিতে সরাসরি সড়ক পথে কোনো যানবাহন যায় না। যার ফলে এখন পর্যন্ত সুপেয় পানির জন্য কোনো ব্যবস্থা করা যায়নি। তবে যতদ্রুত সম্ভব বহরবুনিয়া ইউনিয়নের সর্বত্রই পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১১২৭ ঘণ্টা, জুন ৪, ২০২৪
এসএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।