ঢাকা: আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, বিগত সরকারের সময়ে সুইফট চ্যানেল ব্যবহার করে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দুই বিলিয়ন ডলার চুরি করার পরিকল্পনা ছিল। মূলত গোটা বাংলাদেশকেই লুট করার প্ল্যান ছিল তাদের।
আজ রোববার (১৩ এপ্রিল) আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে উপদেষ্টা এসব কথা জানান।
এতে ড. আসিফ নজরুল বলেন, আজকে আমাদের একটা রিভিউ কমিটির মিটিং ছিল। আপনারা জানেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রায় ৮৮ মিলিয়ন ডলার চুরি করা হয়। সে ব্যাপারে অনেক তদন্ত কমিটি হয়েছে, বিচারকার্য শুরু হয়েছে বিদেশে। প্রকৃত অবস্থা কী এবং এখানে সরকারের করণীয় কী সেটা পর্যালোচনা করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে একটা উচ্চ পর্যায়ের রিভিউ কমিটি করা হয়েছিল। সেই রিভিউ কমিটির প্রথম বৈঠক গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত হয়েছে। রিভিউ কমিটির প্রধান হিসেবে আইন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে আমি ছিলাম। জ্বালানি উপদেষ্টা, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ কমিটির সদস্যরা সবাই উপস্থিত ছিলেন।
তিনি বলেন, আমরা কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সিদ্ধান্ত জানানোর আগে প্রেক্ষিতটা বলি। এটা অবশ্য আমার ব্যক্তিগত মন্তব্য, সেটা হচ্ছে - বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দুই বিলিয়ন ডলার চুরি করার প্ল্যান ছিল। শেষপর্যন্ত করা গেছে ৮৮ মিলিয়ন ডলার। তার মধ্যে ৬৬ মিলিয়ন ডলার আমরা এখনো উদ্ধার করতে পারিনি। আমার কাছে মনে হয়েছে, এটা একটা পুরা বাংলাদেশকেই লুট করার প্ল্যান ছিল। চিন্তা করুন - দুই বিলিয়ন ডলার যদি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে চলে যেত আজকে আমরা প্রায় দুর্ভিক্ষ অবস্থায় পড়তাম। এটা গুরুতর একটা ফিনান্সিয়াল ক্রাইম এবং বাংলাদেশ ঘিরে অনেক বড় ষড়যন্ত্র। এটা তদন্ত করতে গিয়ে তৎকালীন সরকারের আমলে সীমাহীন রাজনীতি করা হয়েছে। সিআইডি তদন্ত যখন একটা ম্যাচিউর পর্যায়ে চলে গিয়েছিল তখন আগেই সিআইডিকে সুনির্দিষ্টভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। সিআইডি থেকে আমরা যেটা জেনেছি , বাংলাদেশ ব্যাংকের যারা যুক্ত আছেন তাদের নাম যেন অভিযোগপত্রে না দেওয়া হয়। এভাবে ইনস্ট্রাকশন দেওয়া হয়েছিল।
উপদেষ্টা বলেন, আমরা এই বিষয়টা অবহিত হয়েছি আজকে। ফরাসউদ্দিন সাহেবের একটা রিপোর্ট ছিল ওটার পর্যালোচনা আমরা শুনেছি। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, প্রক্রিয়াটা বলছি না, বাকি টাকা উদ্ধারের জন্য যে, পদক্ষেপগুলো নেওয়া হচ্ছে সেটার গতিশীলতা আনার জন্য কাজ করছি। বাংলাদেশ থেকে এই অপরাধের জন্য দায়ী ছিল তাদের বিচারের সম্মুখীন করার জন্য সিআইডির যে তদন্তের সেই বিষয়ে পরবর্তী করণীয় ঠিক করব। এই ধরনের অপরাধে পুনরাবৃত্তি রোধে আসলে কী বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিয়েছে, এটা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জানতে চেয়েছি পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিয়েছে নাকি। আমাদের অত্যন্ত অভিজ্ঞ একজন তথ্যপ্রযুক্তি এক্সপার্ট, প্রধান উপদেষ্টার তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়ব স্পেসিফিকলি এটা ডিল করে দেখবেন। আমাদের এই রিভিউ কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে উনাকে আমরা মনোনীত করেছি। সিআইডি রিপোর্টে প্রাথমিকভাবে যাদের নাম এসেছে, ফরাসউদ্দিন সাহেবের রিপোর্টে যাদের নাম এসেছে তাদের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক কী ব্যবস্থা নিয়েছে এটা আমরা জানতে চেয়েছি। ব্যবস্থা কী নিতে হবে সেটাও বলেছি, সেটা এখানে কিছু বলতে চাচ্ছি না। ওই সময় যে লিগাল ফার্মে কাজ দেওয়া হয়েছিল সেই লিগাল ফার্মের সঙ্গে গত সরকারের আমলে সরকারের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সিনিয়র একজন আইনজীবী জড়িত ছিলেন। এই কাজ দেওয়ার প্রক্রিয়াকে, কয়েকদিন আগে ৮ লাখ ডলার পে করা হয়েছে। শুধু ই-মেইল আদান-প্রদান করতে তাদেরকে টাকা দিতে হয়। এই ফার্মটাকে কেন বাছাই করা হয়েছিল এত টাকার বিনিময়ে এর পেছনে সরকারের ঘনিষ্ঠ আইনজীবীর কী রোল ছিল, কোন আর্থিক অনিয়ম হয়েছিল কিনা এবং অস্বাভাবিকতা আছে কিনা সেটা আমরা খতিয়ে দেখব।
তিনি আরও বলেন, আমরা আরেকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সিআইডির যে তদন্তটি ম্যাচিউরড পর্যায়ে রয়েছে তার প্রেক্ষিতে কোন পদক্ষেপ নিলে সেটা নিউইয়র্কে যে বিচারটা হচ্ছে সেটার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে কিনা। বা প্রক্রিয়ার মধ্যে কী সম্পর্ক আছে এক্ষেত্রে আইনগতভাবে ঠিক আমাদের কী করণীয় সেটা পরীক্ষা করে দেখার জন্য ড. কামাল হোসেনের যে ফার্ম আছে সেখানে যোগাযোগ করব এবং ওনাদের পরামর্শের প্রেক্ষিতে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব। এই কমিটির দুই সপ্তাহ পরে আবার যে রোববার আসবে সেদিন আমরা মিটিংয়ে বসব। তিনমাসের মধ্যে মধ্যে কাজ শেষ করব বলে আমরা আশাবাদী।
এই ঘটনার সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কতজন জড়িত বলে চিহ্নিত করা হয়েছে সাংবাদিকদের এমন এক প্রশ্নের উত্তরে আইন উপদেষ্টা বলেন, আপনারা তো ফরাসউদ্দিনের রিপোর্টে অনেকের নাম পাবেন। তখন অনেকেরই ভোট আসছিল যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমান সঠিক সময়ে সঠিক তথ্য না দিয়ে দুই সপ্তাহ না চার সপ্তাহ দেরি করেছিলেন। এগুলো তো তখন পত্রপত্রিকার রিপোর্টে এসেছিল। আরও বেশ কয়েকজন ছিলেন তাদের নাম বিভিন্ন রিপোর্টে এসেছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জালিয়াতি করে সুইফট কোডের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। স্থানান্তরিত এসব টাকা পাঠানো হয়েছিল ফিলিপিন্সে তিনটি ক্যাসিনোতে। এর মধ্যে একটি ক্যাসিনোর মালিকের কাছ থেকে দেড় কোটি ডলার উদ্ধার করে ফিলিপিন্স সরকার বাংলাদেশ সরকারকে বুঝিয়ে দিলেও বাকি ৬ কোটি ৬৪ লাখ ডলার আর পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ সময়: ১৮১২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০২৫
এসকে/এসএএইচ