ঢাকা, বুধবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩২, ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার অধ্যাদেশ: কী রয়েছে আইনে খসড়ায়?

ফাহিম হোসেন, ইউনিভার্সিটি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০২৫
গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার অধ্যাদেশ: কী রয়েছে আইনে খসড়ায়?

ঢাকা: গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকারে অধ্যাদেশ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।  

মঙ্গলবার রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে খসড়া অধ্যাদেশের ওপর বিভিন্ন মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী ও বিচারপতিদের মতামত গ্রহণ করা হয়।

গুমের ঘটনা যদি ‘পদ্ধতিগত ও বিস্তৃত’ (সিস্টেমেটিক এবং ওয়াইডস্প্রেড) হয়, তাহলে সেটিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিচার করার সুযোগ রয়েছে। সেটি সিস্টেমেটিক না হলে তার বিচার করার জন্য বাংলাদেশে কোনো আইন নেই বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।

একইসাথে গুমের সংজ্ঞা কী হবে তা কোথাও উল্লেখ নেই। এসব দিক বিবেচনায় এই আইনটি তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন আসিফ নজরুল।

খসড়া বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আইনের তৃতীয় ধারায় গুমের সংজ্ঞায় দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, (১) কোনো সরকারি কর্মচারী, বা রাষ্ট্র বা কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষের অনুমোদন, সমর্থন বা মৌন সম্মতির বলে কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ-

(ক) যদি কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার, আটক, অপহরণ অথবা অন্য যেকোনো ভাবে স্বাধীনতা-হরণ করে; এবং
(খ) সেই ব্যক্তির স্বাধীনতা-হরণ করার বিষয়টি অস্বীকার করে অথবা ঐ ব্যক্তির নিয়তি বা অবস্থান গোপন রাখে,
এবং এর ফলে ওই ব্যক্তি আইনগত সুরক্ষার বাইরে অবস্থান করে, তাহলে ওই ব্যক্তির কাজ গুম বলে বিবেচিত হবে।

এই সংজ্ঞায় শব্দচয়নে পরিবর্তন আনার কথা বলেছেন আইনজীবী শিশির মনির। তিনি বলেন, আইনে অস্বীকার করার কথা বলা হয়েছে। তাহলে যিনি গুম করার পর স্বীকার করলে তা কী গুম বলে গণ্য হবে না?


দোষ প্রমাণ হলে শাস্তি কী থাকছে
এই ধারায় ২ উপধারায় দোষীদের শাস্তির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। গুমের অপরাধে কেউ দোষী প্রমাণিত হলে এই আইনে তাকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড বা অনধিক দশ বছর কারাদণ্ডে দণ্ড দেওয়া হবে। এর অতিরিক্ত পঞ্চাশ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা হবে।

তবে গুমের ফলে ব্যক্তির যদি মৃত্যু ঘটে, সেক্ষেত্রে দোষী ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হবে এবং অতিরিক্ত এক কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড দেওয়া হবে বলে উপধারা ৩ এ উল্লেখ রয়েছে।

তবে এক্ষেত্রে ‘মৃত্যুদণ্ড’ বাদ দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ার বিষয়ে মত দিয়েছেন গুম সার্ভাইভার মারুফ জামান। একই মত দিয়েছেন মানবাধিকারকর্মী রেজাউর রহমান লেলিন।

এই আইনে গুমের শাস্তি নির্ধারণ করা হলেও গুমের প্রমাণ নষ্ট করলে কী শাস্তি নির্ধারণ করা হবে, তা উল্লেখ করা হয়নি।

এই আইনের অধীনে সংগঠিত সকল অপরাধকে আমলযোগ্য, জামিন অযোগ্য এবং আপোস-অযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা হবে বলে আইনে উল্লেখ রয়েছে।

আইনে গুমকে একটি চলমান অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। গুম করার ক্ষেত্রে যুদ্ধাবস্থা, যুদ্ধের হুমকি, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অথবা জরুরি অবস্থায়; অথবা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা সরকারি কর্তৃপক্ষের আদেশে করা হয়েছে এমন কোনো অজুহাত গ্রহণযোগ্য হবে না।

তবে এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার অজুহাত কতটা তোলা যাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম।  

তিনি বলেন, এসব ক্ষেত্রে বিভিন্ন অজুহাতের পাশাপাশি তারা রাষ্ট্রের নিরাপত্তার অজুহাত দেয়। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে তারা কী করতে পারবে, তা আইনে স্পষ্ট করতে হবে।

কমিশন গঠন

খসড়ায় ৬ ধারায় জাতীয় গুম প্রতিরোধ কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে। তবে কমিশনে কারা সদস্য থাকবেন এবং কীভাবে এই কমিশন গঠন করা হবে, সে বিষয়ে আইনে কোনো তথ্য উল্লেখ নেই।

এই কমিশনকে গুমের অভিযোগ গ্রহণ, তদন্ত পরিচালনা, দেশের যেকোনো কারাগার, হাজতখানা ও আটক-কেন্দ্র সরেজমিন পরিদর্শন করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কমিশন গঠনের আগ পর্যন্ত কমিশনের সব দায়িত্ব জাতীয় মানবাধিকার কমিশন পালন করবে।

তবে চিপ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম মনে করেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে তথ্য চাওয়া বা জিজ্ঞাসাবাদ করার অবাধ অধিকার আইনে উল্লেখ থাকা প্রয়োজন।  

আইন তদন্তের ক্ষেত্রে ৮ এর (২) ধারায় যে প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী অভিযুক্ত, সে প্রতিষ্ঠানের কেউ এই তদন্তে জড়িত থাকতে পারবে না বলে উল্লেখ রয়েছে। তবে তাজুল ইসলামসহ একাধিকজন মত দিয়েছেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তদন্ত চলাকালীন পদ থেকে অব্যাহতি না দিলে কার্যকরী তদন্ত পরিচালনা সম্ভব হবে না।

আইনের ১৩ ধারায় হাইকোর্ট বিভাগে আপিলের সুযোগের উল্লেখ রয়েছে। তবে সেক্ষেত্রে দণ্ড ঘোষণার ১৪ দিনের মধ্যে ব্যক্তিকে তার অর্থদণ্ড বিচারিক আদালতে জমা দিয়ে আপিল করতে হবে। টাকা জমা না দিলে আপিল করা যাবে না।

এই ধারাকে পুনরায় বিবেচনায় বিষয়ে একাধিকজন মত দিয়েছেন। আইনজীবী শিশির মনির এটি না রাখার বিষয়ে মত দেন। চিপ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম এটিকে একটু ন্যূনতম পর্যায়ে রাখার বিষয়ে মত দেন।

আইনের ১৫ ধারায় ভুক্তভোগী এবং সাক্ষীর গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়ে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত নীতিমালা রাখার বিষয়ে মত দিয়েছেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম এবং ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সায়েরা খান।

যেসব ঘটনা আইসিটির মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে আওতাধীন হবে, সেসব ঘটনাকে এই আইনের অধীন রাখা হয়নি।

তবে কোনটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে যাবে এবং কোনটি এই আইনের অধীনে থাকবে, তা স্পষ্ট নয় বলে একাধিকজন মত দিয়েছেন। গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিটির সভাপতি মুইনুল ইসলাম চৌধুরী এটিকে আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়ার বিষয়ে মত দেন।

বাংলাদেশ সময়: ১০১১ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০২৫
এফএইচ/এসআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।