ঢাকা, রবিবার, ৮ ভাদ্র ১৪৩২, ২৪ আগস্ট ২০২৫, ০০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

জাতীয়

সাদাপাথরকাণ্ডে সিলেটের রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড়

নাসির উদ্দিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩:০৪, আগস্ট ২৩, ২০২৫
সাদাপাথরকাণ্ডে সিলেটের রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড়

সাদাপাথর লুটপাটে ৫২ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম এসেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তালিকায়। এ খবর প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই সিলেটের রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে তোলপাড়।

অস্থির হয়ে পড়েছেন নেতারা। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পাথরকাণ্ডে ৫০ জনের নাম ও পদবিসহ জড়িত দুটি প্রতিষ্ঠানের নামও উল্লেখ করা হয়েছে। চিহ্নিত করা হয়েছে ৪২ জনকে। এর মধ্যে বিএনপির ২০, আওয়ামী লীগের ৭, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দুজন করে নেতার নাম রয়েছে।

দুর্নীতির সম্পৃক্ততা আনা হয়েছে কয়েকটি সরকারি দপ্তর, পর্যায়ক্রমে দায়িত্ব পালনকারী চার ইউএনও, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের বিরুদ্ধে। তবে দুর্নীতির দায় অস্বীকার করছেন বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির নেতারা। তারা ধারাবাহিক সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে দুদকের প্রতিবেদনকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। বিষয়টি কতিপয় অদৃশ্য শক্তি দ্বারা চালিত মিডিয়া ট্রায়াল বলেও অভিযোগ করেছেন তারা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই তালিকা সিলেটের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। একে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দাবি করলেও বিষয়টিকে স্বচ্ছ তদন্ত প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দেখছেন তারা।

দুদকের তালিকায় নাম এসেছে মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদীর। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি বলেন, দুদকের তালিকায় আমার নাম আসা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই আমাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।

এ ধরনের সংবাদ প্রকাশের জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনার আহ্বান জানিয়ে কয়েস লোদী আরও বলেন, প্রকৃতপক্ষে বিগত ১৫ বছর থেকে এই এলাকায় তৎকালীন দখলদার আওয়ামী লীগের যোগসাজশে ও প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে লুটপাট চলছে, যা এখনো চলমান। এতে করে আমরা রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে হেয়-প্রতিপন্নই নই; বরং এই ধরনের বাস্তবতাবিবর্জিত কাল্পনিক সংবাদের কারণে আমরা আশ্চর্য হয়েছি। দেশ যখন নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখনই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে টার্গেট করে একটি পক্ষ অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে সারাদেশে বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করেছে। এই ধারাবাহিকতায় গত কিছুদিন থেকে সিলেট বিএনপির নেতাকর্মীদের জড়িয়ে গুজব ও অপপ্রচার করা হচ্ছে। আমরা একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে এই পাথর চুরির সঙ্গে জড়িত সবাইকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানাই।

একইভাবে সংবাদ সম্মেলন করে দায় অস্বীকার করেছে মহানগর জামায়াত। দুদকের তালিকায় নাম আসা মহানগর আমির মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, সাদাপাথরকাণ্ডে জামায়াতের কোনো নেতাকর্মীর সম্পৃক্ততা নেই। তদন্তের নামে আমাদের রাজনৈতিকভাবে হেয় করার চেষ্টা চলছে।

দুদকের প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে সিলেট জেলা ও মহানগর জামায়াতে ইসলামী। পাথর লুটের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে বিবৃতি ও সংবাদ সম্মেলন করেছে দলটি। সে সময় মহানগর জামায়াতের আমির ফখরুল ইসলাম বলেন, সম্প্রতি দুদকের একটি প্রতিবেদন বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছে। ওই তালিকায় তিনিসহ জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি জয়নাল আবেদীনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তা একেবারেই কাল্পনিক। মূলত, পাথর লুটের ঘটনায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জামায়াত নেতাদের নাম জড়ানো হয়েছে। পাথর লুটে কোনো নেতাকর্মী দূরে থাক, জামায়াতের কোনো সমর্থকেরও ন্যূনতম সম্পর্ক নেই।

তিনি আরও বলেন, দুদকের প্রতিবেদনটি ফরমায়েশি। তাছাড়া প্রকৃত লুটকারীদের আড়াল করতেই এই ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। তাছাড়া, দুদক আদৌ এ ধরনের কোনো রিপোর্ট দিয়েছে কিনা, তারা তা নিশ্চিত নন।

এর আগে বৈধভাবে পাথর কোয়ারি খোলার দাবিতে সিলেটের পরিবহন মালিক-শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের একটি কর্মসূচিতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে জামায়াত নেতারাও সম্প্রতি বক্তব্য দিয়েছিলেন। ওই বক্তব্য নিয়ে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে দাবি করে জামায়াত নেতারা লুটপাটকারীদের কঠোর শাস্তির দাবি জানান।

রাষ্ট্রীয় সংস্থা দুদকের রিপোর্ট একপাক্ষিক, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার একটি চেষ্টার অংশ বলে দাবি করেছে এনসিপির সিলেট জেলা ও মহানগরের নেতারা। তাদের অভিযোগ—দুদকের বরাত দিয়ে সম্মানহানিকর প্রতিবেদন প্রকাশ করা হচ্ছে। সাদাপাথর লুটে দুদকের তালিকায় নাম আসার সত্যতা যাচাই করা হয়নি, এটা উদ্বেগজনক। এই উপস্থাপনাটি একপাক্ষিক, তথ্যবিচ্যুত এবং রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। দুদকের এই প্রতিবেদন পাথর লুটের মূল কালপ্রিটদের আড়াল করার কৌশল বলেও দাবি করেছেন তারা।

দলটির দুজন নেতা সিলেট জেলা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করে বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। সাদাপাথর কাণ্ডের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে আমাদের নাম জড়ানো হয়েছে।

পাথর লুটপাটের ঘটনায় কোম্পানীগঞ্জ থানায় ২ হাজার অজ্ঞাত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বিপরীতে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। গ্রেপ্তারদের মধ্যে রয়েছেন পশ্চিম ইসলামপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা আলমগীর আলম। এ ঘটনায় কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি শাহাব উদ্দিনের পদও স্থগিত করা হয়েছে।

স্থানীয় জনমনে প্রশ্ন, সাদাপাথর কাণ্ডে আসলেই কারা জড়িত, আর কারা দায়মুক্ত? দুদকের তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ প্রশ্নের উত্তর অমীমাংসিতই থেকে যাচ্ছে।

সিলেট দুদকের সমন্বিত কার্যালয়ের উপপরিচালক রাফি মো. নাজমুস সাদাত বলেন, সাদাপাথর লুটপাটে জড়িত এমন ৫২ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের একটি তালিকা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পাঠিয়েছি। কমিশন নির্দেশ দিলে পরবর্তী কার্যক্রম চালানো হবে।

উল্লেখ্য, সারা দেশে ৫১টি কোয়ারি (পাথর ও বালু উত্তোলনের নির্দিষ্ট স্থান) আছে। এর মধ্যে সিলেটের কানাইঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুরে রয়েছে আটটি পাথর কোয়ারি। এর বাইরে সিলেটে সাদাপাথর, জাফলং, বিছনাকান্দি, উৎমাছড়াসহ আরও ১০টি জায়গায় পাথর আছে। এসব জায়গা পর্যটনকেন্দ্র হিসেবেও পরিচিত।

বিগত বছরগুলোয় কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন কিংবা ইজারার অনুমতি দেয়নি সরকার। এরপরও আড়ালে-আবডালে রাতের অন্ধকারে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন চলত। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর টানা এক বছর দেদার লুটপাট হয়েছে। বিশেষ করে গত জুলাই থেকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠা সাদাপাথরে নজিরবিহীন লুটপাট হয়। এ কারণে দেশে-বিদেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে।

এনইউ/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।