আপনি ‘অনলাইন সংবাদপত্র’ পড়েন, তার মানে আপনি সংবাদের অন্য যে কোনো মাধ্যমের পাঠক-দর্শকের চেয়ে অনেক এগিয়ে। দেশে বিদেশে যখনই কোনো ঘটনা ঘটে, সঙ্গে সঙ্গেই কিংবা কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনি সে খবর পেয়ে যান।
আধুনিক এই সাংবাদিকতা চতুর্মাত্রিক। মানে অনলাইন সংবাদপত্রে মোটামুটি চারটি মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ করা হয়- ১. লেখা ২. ছবি ৩. অডিও ৪. ভিডিও। এছাড়া এ মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচারেরও সুযোগ আছে (ভিডিও)। এ কারণে অনলাইন সংবাদপত্র ‘সবচেয়ে বস্তুনিষ্ঠ’ সংবাদটিই প্রকাশ করতে পারে। অন্য কোনো সংবাদ মাধ্যমে এটা সচরাচর সম্ভব নয়।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশে এই মাধ্যমের কোনো পরিচর্যা নেই। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা বা তদারকি নেই, স্বীকৃতিও নেই সেই অর্থে। তবু অনেকটা অজান্তেই এটা আজদাহায় পরিণত হয়েছে, কারণ অনেক প্রতিকূল পরিবেশ থাকলেও চর্চা চলছে দীর্ঘদিন ধরেই।
পরিচর্যা আর স্বীকৃতির অভাবেই অনলাইন জার্নালিজম নিয়ে এদেশে এক ধরনের নেতিবাচক কথা আছে। বিশেষ করে নীতিমালা না থাকার কারণে প্রপাগান্ডা ছড়ানোর শত শত অনলাইন গণমাধ্যম গজিয়ে গেছে, যেগুলো সাংবাদিকতার নীতি নৈতিকতা কিছুই মানে না, মানছে না। ফলে নতুন ধারার এ সাংবাদিকতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তারপরও কিছু প্রতিষ্ঠান মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, কিছু দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তাই এ মাধ্যমকে বাদ দিয়ে আর সাংবাদিকতা কল্পনা করা সম্ভব নয়। কারণ এটা আগামীর সংবাদ মাধ্যম। প্রযুক্তি যে পথে এগোচ্ছে তাতে শেষ পর্যন্ত এ মাধ্যমই টিকে থাকবে। পৃথিবীর অনেক সংবাদপত্রই এরই মধ্যে ছাপা বন্ধ করে দিয়ে অনলাইন নির্ভর হয়ে পড়েছে। আমাদের দেশেও তা শুরু হতে হয়তো বেশি দেরি নেই।
ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম অর্থাৎ টেলিভিশন ‘ইরেজেবল’ গণমাধ্যম, মানে একটি সংবাদ একবার প্রচার হয়ে গেলে তা আর সাধারণত দ্বিতীয়বার দেখার সুযোগ নেই। সাধারণ দর্শকের জন্য ডকুমেন্ট রাখারও সুযোগ নেই। আর কাগজের পত্রিকা প্রকাশ হয় ২৪ ঘণ্টা পরপর। এটা পুরোপুরি সংগ্রহে রাখার জিনিস হলেও তাজা সংবাদের মজা নেই। কিন্তু অনলাইন গণমাধ্যম সবসময়ই চলমান ঘটনার সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। আর্কাইভ থাকে, যে কোনো পাঠক ইচ্ছা করলে যে কোনো সময় তার পছন্দের সংবাদটি পড়তে পারেন, প্রিন্ট করতে পারেন, সংবাদের লিংক যেখানে ইচ্ছা পাঠাতে পারেন যতবার খুশি।
অনলাইন সাংবাদিকতা অনেকটা মঞ্চ নাটকের মতো। পাঠক সংবাদের বিষয়ে সরাসরি প্রতিক্রিয়া জানাতে পারেন। এছাড়া পাঠক ইচ্ছা করলে ওই সংবাদ সংক্রান্ত তথ্য দিতে পারেন, ছবি ভিডিও অডিও শেয়ার করতে পারেন। এমন ব্যবস্থা অনলাইন সংবাদ মাধ্যমে থাকে। এছাড়া সংবাদের যে কোনো ভুল ভ্রান্তি তাৎক্ষণিক সংশোধনের সুযোগও আছে।
অনলাইন সাংবাদিকতা নিয়ে দেশের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরাও একসময় নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। তার প্রধান কারণ ভুয়া অনলাইনে সাংবাদিকতার নীতি বিবর্জিত খবর পড়ে তারা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। অন্যদিকে যারা সত্যিই অনলাইন সাংবাদিকতার চর্চা করছেন তাদেরও অভিজ্ঞতা আর পেশাদারিত্বের অভাব ছিল (এখনও কারও কারও আছে)। কিন্তু এ গণমাধ্যম (হাতে গোনা) এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, একে অস্বীকার করার উপায় নেই। এমনকি টিভি ও দৈনিক সংবাদপত্রের সাংবাদিকরাও এখন কিছুটা হলেও অনলাইন সংবাদ মাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল।
এখন অনলাইন সাংবাদিকতায় ‘চতুর্মাত্রিক’ বিষয়টি পরিষ্কার করা যাক। এটা অনেক বড় একটি বিষয়। বুঝতে হলে ব্যাপক আলোচনার প্রয়োজন। অল্প পরিসরে সম্ভব নয়। তারপরও একটা ধারণা দেয় যেতে পারে। ধরুন- এই মাত্র একটি ঘটনা ঘটে গেল। অনলাইন সংবাদপত্রের কাজ হলো সঙ্গে সঙ্গেই তা টেক্সট আকারে বা লিখে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করা। এরপর ঘটনার ছবি পাওয়া গেলে তা যুক্ত করা। পরবর্তী সময়ে যদি ঘটনার ভিডিও পাওয়া যায় তা যুক্ত করা এবং সর্বশেষ ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তির বক্তব্যের ভিডিও ফুটেজ যুক্ত করা। সব সংবাদে এতগুলো উপাদান যুক্ত করা সম্ভব নাও হতে পারে। তবে প্রক্রিয়া এরকমই।
অনেক সময় ঘটনার পূর্ণ বিবরণ পাওয়ার আগেই ছবি কিংবা ভিডিও পাওয়া যেতে পারে। তখন একটি অনলাইন সংবাদপত্র ওই ছবি বা ভিডিওর সূত্র ধরেই সংবাদ তৈরি করে ফেলে এবং পাঠকের জন্য তা প্রকাশ করে থাকে। এক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা আর পেশাদারিত্বের মূল্য অনেক।
পাঠকরাও অনেক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী থাকেন, সে ক্ষেত্রে একজন পাঠকই একটি সংবাদের প্রথম সূত্র হিসেবে আসতে পারেন। তিনি যদি ঘটনাটি একটি অনলাইন সংবাদপত্রকে জানান, সঙ্গে সঙ্গেই ওই পত্রিকার নিউজরুম অ্যাক্টিভ হয়ে ওঠে এবং ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সংবাদ তৈরি করে ফেলে।
অনলাইন সংবাদপত্রে সরাসরি সম্প্রচার তখনই সম্ভব যখন ওই প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টার কিংবা প্রতিনিধি ঘটনার স্পটে উপস্থিত থাকেন। এছাড়া কোনো পাঠকও তার স্মার্টফোনের সাহায্যে সরাসরি সম্প্রচারে ভূমিকা রাখতে পারেন। এটি জটিল আর সংশয়পূর্ণ প্রক্রিয়া হলেও সম্ভব।
অনলাইন সংবাদপত্র শুধু কি চলমান ঘটনার সংবাদই প্রকাশ করে থাকে? না। অন্যান্য গণমাধ্যমের মতোই যে কোনো ঘটনার ফলোআপ, বিশেষ প্রতিবেদন, ফিচারসহ সব ধরনের আর্টিকেলই প্রকাশ করে থাকে। বিভিন্ন মাধ্যমের সাহায্যে তাৎক্ষণিক সংবাদ পরিবেশন করা এ সাংবাদিকতার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
সংক্ষিপ্ত আকারে এতক্ষণ যা বললাম, তা বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রায় ‘পরিপূর্ণ’ অনলাইন সাংবাদিকতার কথা। আরও অনেক বিষয় আছে, যা অভিজ্ঞতা আর প্রযুক্তিগত জ্ঞানের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। এর পুরোটাই চর্চার বিষয়। যেমন- রোবট জার্নালিজম ও ড্রোন জার্নালিজম এখন অনলাইন জার্নালিজমের একটি অংশ হয়ে গেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ নিয়ে কেউ কেউ চর্চা শুরু করেছেন। আমাদের দেশে এ সম্পর্কে ধারণা আছে খুব কম সংখ্যক সাংবাদিকেরই।
অনলাইন সাংবাদিকতা মানুষকে সময়ের সঙ্গে চলতে সাহায্য করছে। দৈনন্দিন জীবনের অনেক বিষয়ের সমাধানও মানুষ পেয়ে যাচ্ছে সহজেই। যেমন- নেপালে বাংলাদেশের একটি উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হলো। বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের মানুষ কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই তা জানতে পারলো অনলাইন গণমাধ্যমের কল্যাণে। একইসঙ্গে জানা গেল নেপালের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি ক্লোজ করা হয়েছে। ফলে ওইদিন নেপালে বিভিন্ন দেশ থেকে যাদের উড়োজাহাজে করে যাওয়ার কথা ছিল তারা জেনে গেলেন, তাদের ফ্লাইট দেরিতে ছাড়বে। এ ধরনের যে কোনো মুহূর্তে যে কোনো সমস্যা বা সম্ভাবনার কথা কিন্তু অনলাইন গণমাধ্যমগুলো সবার আগে প্রকাশ করতে পারে।
অনলাইন সাংবাদিকতার সুফল যেমন আছে, তেমনি এর কুফলেরও অভাব নেই। বিশেষ করে আমাদের দেশে এই গণমাধ্যম চালানোর বিষয়ে এখনও কোনো নীতিমালা নেই। অনুমোদনের বিষয়টি অত্যন্ত দুর্বল। উপযুক্ত যাচাই বাছাই ছাড়াই অসংখ্য অনলাইন গণমাধ্যমের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আড়ালে আবডালে বিভিন্ন ধরনের অনলাইন গণমাধ্যম প্রপাগান্ডা উসকানি ছড়ানোর কাজ করে যাচ্ছে, ভুয়া সংবাদ প্রকাশ করে যাচ্ছে, যা জননিরাপত্তা ও জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি। আর নীতিমালা না থাকার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অনলাইন সাংবাদিকতা। সমাজের বিভিন্ন স্তরে ঢুকে পড়ছে ভুল তথ্য, ভুল দর্শন ও ভুল মতবাদ।
চতুর্মাত্রিক বা বহুমাত্রিক মাধ্যম দিয়ে তৈরি একটি সংবাদ পাঠকের সামনে প্রকাশ করা তখনই সম্ভব, যখন একটি অনলাইন গণমাধ্যম পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এর জন্য প্রথমত এ সেক্টরের অভিজ্ঞ সাংবাদিক প্রয়োজন। সঙ্গে লোকবল আর পরিকল্পনা। অনেকেই মনে করে থাকেন- একটি ওয়েবসাইট তৈরি করে দুচারজন সাংবাদিককে ল্যাপটপ-কম্পিউটার ধরিয়ে দিলেই একটি অনলাইন গণমাধ্যম দাঁড় হয়ে যায়। কিন্তু বাস্তবতা ঠিক এর উল্টো।
প্রথমত অনলাইন সাংবাদিকতার প্রথম শর্তই হলো আধুনিক প্রযুক্তির একটি ওয়েবসাইট। পাঠকের কাছে সহজে বিশ্বাসযোগ্য সংবাদ পৌঁছাতে হলে বিভিন্ন মাধ্যমের যে ব্যবহার করতে হবে, তার সুবিধা ওই ওয়েবসাইটে থাকতে হবে। এর সঙ্গে ওয়েব দুনিয়ার আরও নানারকম বিষয় সংশ্লিষ্ট আছে, সেগুলোর সুরাহা করতে হবে। একটি অনলাইন পত্রিকার সংবাদ পড়তে পাঠক যদি সমস্যা অনুভব করে, তাহলে অন্য সব চেষ্টায় বৃথা হয়ে যাবে। যত ভালো সংবাদই হোক না কেন, কারণ পাঠক আর ফিরবে না।
যারা একটি অনলাইন সংবাদ মাধ্যমের চালকের আসনে থাকবেন, তাদের আসলে সময়টাকে ধারণ করতে হবে। পাঠকের মনের কথা বুঝতে হবে। প্রযুক্তি বুঝতে হবে, সর্বোপরি সংবাদের মানুষ হতে হবে। এরপর পরিসরের কথা ভাবতে হবে। একটি অনলাইন সংবাদ মাধ্যম যদি দেশ বিদেশের সব ধরনের সংবাদ প্রকাশের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়, তবে সে অনুযায়ী লোকবল আর পরিকল্পনা থাকতে হবে। অন্যদিকে খেলাধুলা, বিনোদন, ব্যবসা কিংবা অন্য যে কোনো বিষয়ে স্পেশালাইজড বা ক্লাসিফায়েড অনলাইন গণমাধ্যমও পরিকল্পিত না হলে মুখ থুবড়ে পড়বে।
দুচার জন সাংবাদিক দিয়ে বড় পরিসরের একটি অনলাইন গণমাধ্যম চালানো সম্ভব নয়। আর যদি জোর করে চালানোর চেষ্টা করা হয়, তবে অন্য প্রতিষ্ঠানের সংবাদ চুরি করা ছাড়া উপায় নেই। আর চুরি করা সংবাদ দিয়ে পাঠকের আস্থা অর্জন সম্ভব নয়।
অনলাইন সাংবাদিকতার একটি বড় সমস্যা হলো প্রভাবিত হয়ে সংবাদ প্রচার করা। যদি একটি অনলাইন গণমাধ্যমের কর্মকর্তারা অভিজ্ঞ না হন, তাহলে এ সমস্যা চলতেই থাকে এবং একসময় ওই গণমাধ্যমকে নেতিবাচক পরিণতি ভোগ করতে হয়। এমন উদাহরণ আমাদের দেশে আছে।
প্রভাবিত হয়ে সংবাদ প্রচার করার অর্থ হলো- কোনো একটি ক্লু পেয়ে যাচাই না করে হুট করেই সংবাদ প্রকাশ করা। কিংবা কারো কথায় সহমত পোষণ করে সংবাদ প্রকাশ করা। সাধারণত অনলাইন গণমাধ্যমগুলোর মধ্যে সংবাদ আগে প্রকাশ করার এক ধরনের প্রতিযোগিতা থাকে, এই প্রতিযোগিতার কারণেই এটা বেশি হয়ে থাকে। ধরা যাক নেপালে বিমান বিধ্বস্ত হলো। কতজন মারা গেছেন এটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এরই মধ্যে স্যোশাল মিডিয়ায় একটি পোস্ট থেকে জানা গেল, বিমানে থাকা সব আরোহী মারা গেছেন। ব্রেকিং সংবাদ দেওয়ার প্রতিযোগিতার কারণেই একটি অনলাইন গণমাধ্যম বিমানে থাকা সবার নিহত হওয়ার সংবাদ প্রকাশ করে দিল। কিন্তু শেষে দেখা গেল বিমান দুর্ঘটনায় অনেকেই বেঁচে গেছেন। এটা প্রভাবিত সংবাদের একটি ছোট্ট উদাহরণ মাত্র। তবে প্রভাবিত হয়ে অন্য গণমাধ্যমেও সংবাদ প্রকাশ করা হয়। কিন্তু দোষটা বেশি হয় অনলাইন সাংবাদিকতার, কারণ এখানে পাঠকের যাচাই করার সুযোগ থাকে ষোলো আনা।
তবে সবকিছুর শেষ কথা হলো দিন যত গড়াচ্ছে, অনলাইন সাংবাদিকতার প্রসার তত বাড়ছে। অন্যান্য গণমাধ্যমগুলো পাঠক দর্শক কমছে। মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে অনলাইন গণমাধ্যম। কারণ এর জন্য আলাদা পয়সা খরচ করতে হচ্ছে না, হাতের মোবাইল ফোন দিয়েই যত ইচ্ছা অনলাইন সংবাদপত্র পড়া যাচ্ছে। ইন্টারনেট যত সহজলভ্য হবে এ গণমাধ্যমের প্রসার ততো বাড়বে। একইসঙ্গে এ গণমাধ্যম পাঠকের মনে প্রযুক্তির সাহায্যে অন্যরকম এক অবস্থান সৃষ্টি করে নেবে, এটাই ভবিষ্যৎ।