ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে ও পরে দেশের কারাগারগুলোতে নজিরবিহীন বিদ্রোহ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। সেই সময়ে একাধিক কারাগারে সংঘর্ষে ১৩ জন বন্দি নিহত হন এবং অনেক কারারক্ষী আহত হন।
অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে কারাগার পুনর্গঠন
নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই দেশের কারা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হয়। যোগ দেন নতুন কারা কর্মকর্তারা। ভঙ্গুর পরিস্থিতির মধ্যেই তারা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দায়িত্ব নেন। ধীরে ধীরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন করে শান্তি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। কারারক্ষীদের সঙ্গে সমন্বয়ে দেশের প্রতিটি কারাগারে ফেরে নিয়ন্ত্রণ ও স্থিতিশীলতা।
এ সময় বন্দিদের মনোবল বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আয়োজনও করা হয়। দুটি ঈদ উৎসব বন্দিদের সঙ্গে উদযাপন করা হয় কারাগার প্রাঙ্গণে, যা বন্দিদের মধ্যে স্বস্তি ফিরিয়ে আনে।
২৪ ঘণ্টা সতর্কতা, নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ
কারা সূত্রে জানা যায়, বন্দিরা সবসময় চার দেওয়ালের ভেতরে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে থাকেন। প্রতিদিন তিন থেকে চারবার বন্দিদের গণনা করা হয়—সকালে, বিকালে, সন্ধ্যায় এবং লকআপের পর। কতজন বন্দি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন, কতজন হাজিরা শেষে আদালত থেকে ফিরেছেন—এসব নিয়মিতভাবে যাচাই করা হয়।
কারাগার কর্তৃপক্ষের নিজস্ব গোয়েন্দা ইউনিট (পিআইইউ) রয়েছে, যারা হঠাৎ ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করে থাকেন। এসব অভিযানের তথ্য আগাম কারাগারের ভেতরে নিরাপত্তায় থাকা কারারক্ষীরাও জানেন না, যা নিরাপত্তার একটি বাড়তি স্তর যোগ করে।
কাশিমপুর কারাগারে বিভ্রান্তি
চলতি আগস্ট মাসে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে তিন বন্দির ‘পালানোর চেষ্টা’ সংক্রান্ত একটি ঘটনা নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। তবে কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ঘটনাটি প্রকৃতপক্ষে পালানোর চেষ্টা ছিল না। দুই ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত বন্দি ও একজন সাধারণ বন্দি কারাগারের ভবনের প্লাস্টার কোনো কারণে খোঁচাখুঁচি করছিলেন, যা কারারক্ষীদের চোখে পড়ে। কারারক্ষীরা যদি সজাগ না থাকতেন, তাহলে বিষয়টি হয়তো ধরা পড়তো না। ঘটনাটি স্থানীয় থানায় জানানো হয়েছে নিয়ম অনুযায়ী।
কারা কর্মকর্তারা বলেন, বন্দিদের মধ্যে কেউ কেউ পালানোর চিন্তা করতে পারেন, তবে সেটা রুখতেই সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়। কারাগারে কোনো বন্দি থাকতে চান না। এটা স্বাভাবিক ব্যাপার।
দেশে ৭৩ কারাগারে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা
বর্তমানে কেরানীগঞ্জের নতুন বিশেষ কারাগারসহ দেশে মোট ৭৩টি কারাগার রয়েছে। প্রতিটি কারাগারে বন্দিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রশিক্ষিত কারারক্ষী এবং কর্মকর্তারা সর্বোচ্চ দায়িত্ব পালন করছেন। গোয়েন্দা নজরদারি ও প্রযুক্তিনির্ভর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কারাগারগুলো পরিচালিত হচ্ছে।
কারা কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, কারাগার একটি সরকারি নিরাপত্তা-প্রতিষ্ঠান, যেখানে বিনা কারণে আতঙ্ক ছড়ানো অনুচিত। সঠিক নিয়মনীতি ও তদারকির মাধ্যমে বন্দি ও কারারক্ষী—উভয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই সরকারের অগ্রাধিকার।
কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন সোমবার (১১ আগস্ট) বাংলানিউজকে বলেন, কারাগারে বন্দিদের নিরাপত্তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিশ্চিত করা হচ্ছে। তাই ‘রেড অ্যালার্ট’ জারির কোনো প্রয়োজন নেই। এমনকি ‘রেড’ বলতে কারাগার ব্যবস্থাপনায় কোনো শব্দ বা ধারণার অস্তিত্ব নেই।
তিনি বলেন, কারাগার একটি সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা স্থান। এটি উন্মুক্ত কোনো জায়গা নয়। এখানে সবাই চার দেয়ালের মাঝে থাকেন এবং তারা সবাই কোনো না কোনো অপরাধের কারণে কারাবন্দি। এখানে অনেক দুর্ধর্ষ বন্দি রয়েছেন, তাই নিরাপত্তার কোনো ঘাটতির সুযোগ নেই। আমাদের কারারক্ষী ও কর্মকর্তারা সবসময় সজাগ থাকেন এবং সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারের একটি মেঝেতে ছিদ্র পাওয়া প্রসঙ্গে কারা মহাপরিদর্শক জানান, এটি কয়েকজন বন্দির জেল থেকে পালানোর প্রচেষ্টা কি না, এ বিষয়ে সন্দেহ হওয়ায় অধিকতর তদন্তের জন্য থানায় একটি অভিযোগ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের নিরাপত্তা সদস্যরা সজাগ ছিলেন বলেই বিষয়টি দ্রুত শনাক্ত করতে পেরেছেন।
কারা মহাপরিদর্শক আরও বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পর আমরা যে অবস্থায় কারাগার পেয়েছিলাম, সেখান থেকে ধাপে ধাপে উন্নতি করছি। বর্তমানে কারাগারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পূর্বের যেকোন সময়ের তুলনায় অধিকতর সুসংহত। তবে কারাগারে কিছু কিছু বন্দি থাকেন, যারা সবসময় মনে মনে পালানোর পরিকল্পনা করেন এবং সুযোগের অপেক্ষায় থাকে—এটা অস্বাভাবিক নয়। তবে আমরা সবসময় সতর্ক থাকি, যাতে নিরাপত্তা সংক্রান্ত কোনো ঝুঁকি তৈরি না হয়।
এজেডএস/এমজেএফ