মিরপুর ১৩ নম্বর এলাকার রাস্তার ফুটপাত থেকে ভেসে এলো খিচুড়ির গন্ধ। তাকাতেই চোখে পড়লো রাস্তার ফুটপাতের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে একটি ভ্যানগাড়ি।
এনায়েতের জীবনে সহজ কোনো পথ ছিল না। এক সময় কাজের সন্ধানে ঘুরেছেন, কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি। স্ত্রী-সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নেন যা আছে, তাই দিয়েই শুরু করবেন। হাতে ছিল ছয়-সাত হাজার টাকা। চার-পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে কিনলেন একটি ভ্যান। পরে কিনলেন একটি গ্যাসের চুলা, কয়েকটি কড়াই আর হাঁড়িপাতিল।
কাক ডাকা ভোরে স্বামী-স্ত্রী মিলে রান্না করেন মজাদার এই খাবারগুলো। এনায়েত ভ্যান নিয়ে বের হন মিরপুর ১০, ১৩, ১৪ এলাকার ফুটপাতে। প্রতিটি প্লেটে খিচুড়ির সাথে ডিম বা মাংস, ভাজি যার যা পছন্দ, আর ডাল ও ভর্তা থাকছে বিনামূল্যে। দাম কম, স্বাদ ভালো ফলে ক্রেতাদের ভিড় লেগেই থাকে।
কখনো তার খাবার বাসি হয় না। সকাল ১০টা থেকে দুপুর দুইটা বা চারটার মধ্যেই সব বিক্রি হয়ে যায়, যদি কখনো বৃষ্টি-বাদল হয় সেক্ষেত্রে একটু সময় বেশি লাগে।
এনায়েত বাংলানিউজকে বলেন, আমার বাড়িমাদারীপুরের কালকিনিতে, বহুদিন ধরে ঢাকায় থাকি। এখানে অনেক রকমের কাজ করেছি। তাতে সংসার ঠিকমতো চালাতে পারতাম না। কারণ সংসারটা ছিল ছয়জনের। তারপর বাবা-মায়ের খোঁজখবর নিতে হয়। কি করবো দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। হাতে যা টাকা ছিল তাই নিয়ে এই ভ্যানগাড়ি, গ্যাসের চুলা, হাঁড়িপাতিল কিনেছিলাম নয় মাস আগে। বাকি মাত্র দুই হাজার টাকা ছিল সেই টাকা নিয়ে বাজার করে এই ফুটপাতে ভ্রাম্যমাণ হোটেল ব্যবস্থা শুরু করি।
এখন আল্লাহর রহমতে সন্তানদের স্কুলে পড়তে পারছি। আমার এক ছেলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে আর এক ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে আর দুইজন ছোট। মাত্র দুই হাজার টাকার পুঁজি নিয়ে এই ভ্যানগাড়িই আমার জীবন বদলে দিয়েছে। আগে সংসার চালানো কষ্ট ছিল। এখন আল্লাহর রহমতে প্রতিদিন হাজার থেকে ১২শ টাকা আয় হয়। ছেলে স্কুলে পড়ে, সংসার চলে, এটা আমার সবচেয়ে বড় সাফল্য।
তার স্ত্রীও পাশে থাকেন সব সময় কখনো রান্নায়, কখনো বাজারে। একসাথে এই ভ্যানগাড়ি ব্যবসা এখন শুধু আয়ের পথ নয়, বরং আত্মনির্ভরতার প্রতীক।
এনায়েতের দোকানে খাবার খেতে আসা মোহাম্মদ ইমুল হাসান নামের এক অটোরিকশাচালক বাংলানিউজকে বলেন, বহুদিন হলো, এই ভ্যানগাড়ি থেকে খাবার কিনে খাচ্ছি। রান্না বেশ মজা। মুরগি-খিচুড়ি মাত্র ৬০ টাকা খাওয়া যায়। এ ছাড়া পেটভরে ডাল ও ভর্তা ভাজি ফ্রিতে খাওয়া যায়।
এনায়েত ভাই শুধু একজন ব্যবসায়ী নন, তিনি আমাদের গরিবের বন্ধু। ভাই প্রমাণ করেছেন অল্প পুঁজি আর দৃঢ় মনোবল দিয়েই জীবনকে নতুন করে গড়া সম্ভব বলেন ওই অটোচালক।
ফুটপাতের কোণে দাঁড়িয়ে আছে এনায়েতের ভ্যানগাড়ি। যেন একটি চলমান রান্নাঘর, যেখানে ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ির গন্ধে ভরে থাকে বাতাস। হাতে গরম প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন সিএনজিচালিত অটোচালক, অটোরিকশাচালক, দিনমজুর—যাদের কষ্টের টাকায় পেট ভরে খাওয়া বড় বিলাস।
এনায়েত জানালেন, এরা সবাই তার মতোই পরিশ্রমী মানুষ। তাই তিনি কখনো খাবারের মানে কমতি রাখেন না, দাম রাখেন সাধ্যের মধ্যে। অনেক সময় পকেটে টাকা না থাকলেও হাসিমুখে বলেন খেয়ে যান ভাই, টাকা পরে দিয়েন।
এই মানবিক আচরণই তাকে আলাদা করে দিয়েছে অন্য বিক্রেতাদের থেকে। ভ্যানগাড়ির সামনে জমে ওঠা ভিড় শুধু খাবারের স্বাদের জন্য নয়, এনায়েতের আন্তরিকতার জন্যও। যদিও বৃষ্টির জন্য আজ লোকজনের সংখ্যা খুবই কম।
জিএমএম/এএটি