প্রবাসী আয় আগের বছরের চেয়ে বাড়লেও বৈদেশিক কর্মসংস্থানে রয়ে গেছে স্থবিরতা। অন্যতম বড় বাজার মালয়েশিয়া ও ওমান বন্ধ রয়েছে, সংযুক্ত আরব আমিরাতে অস্থিতিশীলতার প্রভাব পড়ছে পুরো বৈদেশিক কর্মসংস্থানে।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যমতে, ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে মোট ১০ লাখ ১৬ হাজার ৬৪ মানুষ বিদেশে গেছে। বিদেশে যাওয়া এই জনশক্তি আগের অর্থবছরের সমান। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে বিদেশে গেছে ১০ লাখ ১১ হাজার ৯৬৯ জন।
চলতি ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বিদেশে কাজের সন্ধানে গেছে ৭৩ হাজার ৪০ জন। আর গত বছরের আন্দোলন-বিক্ষুব্ধ জুলাইয়ে গিয়েছিল ৭১ হাজার ৪৪১ জন।
অন্যদিকে আগের বছরের চেয়ে ২৭ শতাংশ বেশি প্রবাসী আয় এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ তিন হাজার ৩২ কোটি ৮৮ লাখ ডলার। আগের বছরে আসে দুই হাজার ৩৯১ কোটি ২২ লাখ ডলার।
তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সৌদি আরবে সর্বোচ্চ সংখ্যক সাত লাখ ৩৯ হাজার ৫৭১ জন মানুষ কাজের সন্ধানে গেছে। এরপর কাতারে ৮২ হাজার ৩৩৮ জন, কুয়েতে ৩২ হাজার ৯৯৫ জন, সিঙ্গাপুর ৬২ হাজার ৯৮৬ জন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১৭ হাজার ৭২৯ জন, জর্ডানে ১২ হাজার ৯৪৫ জন এবং মালদ্বীপে ১২ হাজার ৪৫৩ জন।
সর্বোচ্চ সংখ্যক জনশক্তি যাওয়া সৌদি আরব থেকে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় আসে ৪২ কোটি ৬৩ লাখ ৬০ হাজার ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রবাসী আয় এসেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ২৮ কোটি ৩৮ লাখ ৩০ হাজার ডলার। এরপর মালয়েশিয়া থেকে ২৬ কোটি ৬৯ লাখ ৫০ হাজার ডলার, ওমান থেকে ১৩ কোটি ৯৭ লাখ ৯০ হাজার ডলার, কুয়েত থেকে ১৩ কোটি ২০ লাখ ৮০ হাজার ডলার এবং কাতার থেকে ১০ কোটি ৫৬ লাখ ২০ হাজার ডলার এসেছে।
বিদেশে যে হারে যাচ্ছে, সেই হারে বাড়ছে না আয়
দেশে থেকে প্রতি বছরে ১০ থেকে ১১ লাখ মানুষ কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে গেলেও সেই হারে প্রবাসী আয় বাড়ছে না। তথ্য বলছে, প্রবাসী আয় বছরে ২৫-২৬ বিলিয়ন ডলারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। এক বছরে ১০ লাখ মানুষ বিদেশে গেলে আগের মানুষের সঙ্গে যুক্ত হয়। কিছু মানুষ দেশে ফিরে এলেও তা এক বছরে বিদেশে যাওয়া মানুষের এক-তৃতীয়াংশও নয়। সে হিসাবে প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। কিন্তু চিত্র বলছে গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কিছুটা বাড়লেও আগের বছরগুলোতে সেই হারে প্রবাসী আয় বাড়েনি।
এ বিষয়ে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, যদি আমি তুলনা করি গত দশ বছরে প্রায় এক কোটি লোক বিদেশে গেছে। কিন্তু প্রবাসী আয় সেই তুলনায় বাড়েনি। যে হারে কাজের সন্ধানে মানুষ বাইরে গেছে, সেই হারে প্রবাসী আয় বাড়ার কথা ছিল।
এক সৌদি আরবের বাজারেই গত ছয় বছরে অন্তত ৪০ লাখ মানুষ গেছে। একক বাজারে যে ৩০/৪০ লাখ লোক গেল, কিন্তু ২০২১-২২ অর্থবছরে যে পরিমাণ প্রবাসী আয় এলো পরের দুই বছরে ক্রমান্বয়ে কমলে। দেশটিতে বৃদ্ধি না পেয়ে বরং উল্টো দুই বিলিয়ন কমল।
শরিফুল হাসান আরও বলেন, আমার মনে হয় সংখ্যার চেয়ে দক্ষ কর্মী পাঠানো বেশি দরকার। কারণ বৈদেশিক কর্মসংস্থানে আমরা যে কর্মী পাঠাই তারা বেশির ভাগই অদক্ষ। তারা সবচেয়ে বেশি খরচ করে সবচেয়ে কম আয় করতে গিয়ে। গড় আয় আমাদের প্রবাসীদের খুবই কম। তাই গণহারে লোক পাঠানোর চেয়ে দক্ষ লোক পাঠানো দরকার।
ডোনাল্ড ট্রাম্প সিনড্রমে বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ে ধাক্কা
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশটিতে প্রবাসীদের ওপর খড়গ নেমে এসেছে। এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের প্রবাসী আয়েও। জনশক্তি পাঠাতে প্রথম ৫০টি দেশের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র না থাকলেও প্রবাসী আয় আনার ক্ষেত্রে দেশটি পঞ্চম। গত কয়েক বছর ধরে প্রবাসী আয় পাঠানোতে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল যুক্তরাষ্ট্র। এক বছর প্রথম স্থানও দখল করে দেশটি। এবার নেমে এসেছে পাঁচে।
বৈদেশিক কর্মস্থানে প্রথম ২০টি দেশের মধ্যে না থেকেও প্রবাসী আয়ে তৃতীয় যুক্তরাজ্য। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশটি থেকে প্রবাসী আয় আসে ২৮ কোটি ২৫ লাখ ৫০ হাজার ডলার। এরপর ইতালি থেকে ১৬ কোটি ৮৯ লাখ ৬০ হাজার ডলার। এ ছাড়া জাপানে তুলনামূলক কম লোক পাঠিয়েও উল্লেখযোগ্য প্রবাসী আয় এসেছে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবাসী আয় বেড়েছে, বেড়েছে ইতালি থেকেও। এর মানে হলো ইউরোপের দেশ থেকে বেড়েছে। এই বৃদ্ধির মূলে রয়েছে ডলারের বাড়তি দর, ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ডলার আনা সহজ করা এবং ডলারের খোলাবাজারের দামের সঙ্গে সমন্বয় করা; মনে করেন ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবাসী আয় দুই নম্বর অবস্থান থেকে পঞ্চমে নেমে গেছে। এক-দুইবারের তথ্য দিয়ে বিচার করা যাবে না উল্লেখ করে শরিফুল হাসান বাংলানিউজকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাণ্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর অনেকে কর্মসংস্থান হারিয়েছেন। সেখানে লোকজনকে ধর-পাকড় করা হচ্ছে, অনেকে কাজ হারাচ্ছেন, এ কারণে প্রবাসী আয় কম হয়েছে।
বিকল্প বাজার সৃষ্টি
দেশ থেকে প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক মানুষ বিদেশে গেলেও বৈদেশিক কর্মসংস্থানে বাংলাদেশের অবস্থান টেকসই নয়। বৈদেশিক কর্মসংস্থান নির্দিষ্ট কিছু দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং যারা যাচ্ছে তারাও অদক্ষ। ফলে প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বা অন্য কোনো কারণে সাময়িক সমস্যা সৃষ্টি হলেই প্রবাসী আয়ে সংকট তৈরি হয়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রত্যাশা অনুযায়ী বৈদেশিক কর্মসংস্থান হয়নি। কারণ হলো মালয়েশিয়া ও ওমানের কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে আছে। বিকল্প যে শ্রমবাজারের বিষয়টি আছে, সেটি এখনো ভালো করতে পারিনি। আর যে বছর কর্মসংস্থান কমে বা বাড়ে ওই বছরই বৈদেশিক আয় এর সঙ্গে যুক্ত হয়, এমন নয়।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনোমিস্ট ড. জাহিদ হাসান বাংলানিউজকে বলেন, সৌদি আরবের নীতির কারণে প্রবাসী আয়ে কিছুটা টান পড়ে। ওরা বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা বসিয়েছিল। শেষ খবর হলো, তারা তা জুন মাসের দিকে কিছুটা উঠিয়েও দিয়েছে। কিন্তু মাঝে ফেব্রুয়ারি-মার্চের দিকে টাইট করে দিয়েছিল। সৌদি আরব নিজের দেশ থেকে কর্মী না পেলেই কেবল বাইরে থেকে লোক নিয়ে আসবে, এমন একটি শর্ত দিয়েছিল। মালয়েশিয়া কর্মসংস্থানে সুযোগ কখনো তোলে, কখনো বন্ধ করে, দেশটির নীতি স্থিতিশীল নয়।
জাহিদ হাসান আরও বলেন, সৌদি যে নীতি নিয়েছিল, অদক্ষ লোকও যদি দেশের মধ্যে পাওয়া যায়, তাহলে বিদেশ থেকে আনা যাবে না। এটা তো বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কারণ সৌদি আরবের লোক অদক্ষ শ্রমিকের কাজ করবে না। অদক্ষ লোকও তাদের দরকার। সেটা শ্রীলংকা থেকে নেবে, না হয় ভারত থেকে নেবে, নয়তো বাংলাদেশ থেকে নেবে, কিন্তু লোক তাদের নিতেই হবে।
প্রবাসী আয় খায় হুন্ডি ও পাচার
সাম্প্রতিক প্রবাসী আয়ের ধারা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৮ থেকে ২৩ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে। এর বাইরে দুই বছর অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে করোনা মহামারির জন্য মানুষ ডলার নিয়ে দেশে ফেরত আসার কারণে প্রবাসী আয় ১৮ বিলিয়ন থেকে বেড়ে প্রায় ২৫ বিলিয়ন হয়। আর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২৩ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলারে উঠে ব্যাংকিং খাত ও আমদানি-রপ্তানিতে কড়াকড়ির কারণে।
শরিফুল হাসান বলেন, হুন্ডির টাকা কোনোভাবেই কোনো কাজে আসে না। হুন্ডিতে বিদেশের টাকা বিদেশেই থাকে। প্রবাসীর টাকা দেশে আসে না। আমরা বিদেশে কর্মী পাঠাই ডলার আসবে এ জন্য। এই টাকা যদি না আসে, ডলার যদি দেশে না আসে তাহলে এই কর্মী পাঠানো অর্থহীন।
তিনি বলেন, আমাদের দক্ষ কর্মী বিদেশে পাঠানো দরকার। এক্ষেত্রে আমাদের সুশাসনের ঘাটতি আছে। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের পর থেকে প্রবাসী আয় দেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে আমাদের প্রবাসীদের যে অবদান সেই তুলনায় রাষ্ট্র তাদের জন্য বেশি কিছু করেছে, সেটা আমরা দেখি না। আসলে অভিবাসী খাতটা আমূল সংস্কার প্রয়োজন।
সমস্যা সমাধানে করণীয়
কর্মসংস্থানের জন্য যেমন দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর দরকার। বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিদেশমুখী মানুষকেও সতর্ক হতে হবে। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনোমিস্ট ড. জাহিদ হাসান বলেন, বৈধপথে গিয়ে অবৈধ হওয়ার কারণে অনেক সময় দেশের দুর্নাম হয়। তখন অভিযান চালায়, লোক পাঠানো বন্ধ করে দেয়। এজন্য যারা যাচ্ছে, তারা তা টেম্পোরারি ভিসা নিয়ে যায়, বা এক বছরের জন্য ভিসা নিয়ে যায়। এক বছরের মধ্যে নবায়ন হলো না, সে আর আসলো না। এমন অবস্থায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তখনই সংকট তৈরি হয়।
তিনি বলেন, নবায়নের ক্ষেত্রে আমাদের দূতাবাসগুলোকে আরও সক্রিয় হতে হবে। আমরা শুনতে পাই, প্রবাসীরা দূতাবাসে গেলে দূতাবাসের কর্মকর্তারা বের হন না, মানুষের সঙ্গে দেখা করতে চান না, বকাবকি করেন। এমনকি একটি পাসপোর্ট নবায়ন করতে গেলে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। সৌদি আরব, মালিয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত বড় বাজার। এসব দেশে প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য ভিন্ন ডেস্ক বসানোর দরকার, যাতে পাসপোর্ট-ভিসা বা অন্য কোনো ডকুমেন্টেশন করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা পান। এই ধরনের জানাশোনাও নেই তাদের। দূতাবাসগুলোকে প্রবাসী শ্রমিক বান্ধব হওয়া দরকার।
জেডএ/এমজেএফ