ঢাকা, সোমবার, ১০ ভাদ্র ১৪৩২, ২৫ আগস্ট ২০২৫, ০১ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

বিশেষ কারাগারে ৬৫ দোসরের সেবায় ৭২ কয়েদি

আবাদুজ্জামান শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬:০৯, আগস্ট ২৫, ২০২৫
বিশেষ কারাগারে ৬৫ দোসরের সেবায় ৭২ কয়েদি

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে গ্রেপ্তার হওয়া ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিরা কেরানীগঞ্জের বিশেষ কারাগারে এখন যেন অন্য এক জগতে। সাধারণ বন্দিদের মতো কষ্ট নয়, তারা ডিভিশন পেয়ে বসে বসে চা পান করছেন, পা দুলিয়ে পড়ছেন জাতীয় পত্রিকা, খাচ্ছেন আলাদাভাবে রান্না করা বাড়তি খাবারও।

 

গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত হয়েও কারাগারে তাদের এমন ভিআইপি সুবিধা কতটা যৌক্তিক, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন। এমন তথ্য পাওয়ার পর অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের এসব মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে মামলা চলছে। তারা ভিআইপি হিসেবে যদি ডিভিশন পেয়ে থাকেন, তাহলে তাদের অপরাধ অনুযায়ী এ সুবিধা কতটুকু প্রাসঙ্গিক তা বিবেচনা করা প্রয়োজন।  

সোমবার (২৫ আগস্ট) কারা সূত্রে জানা গেছে, কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে অবস্থিত এই বিশেষ কারাগারটি সম্পূর্ণ আলাদা একটি স্থাপনা, যা ছিল নারীদের জন্য। আনুমানিক পাঁচ বছর যাবত খালি পড়ে থাকা কারাগারটি এখন বিশেষ কারাগার হিসেবে ব্যবহার করছে কর্তৃপক্ষ। এই কারাগারে বর্তমানে বন্দি সংখ্যা ১৩৭। এদের মধ্যে কয়েদি সংখ্যা ৭২, অর্থাৎ তাদের মামলার রায় হয়েছে এবং তারা সাজা খাটছেন। বিশেষ বন্দি রয়েছেন ৬৫ জন, তাদের মধ্যে ৫৫ জন আবার ডিভিশনপ্রাপ্ত। তাদের দেখভাল ও দৈনন্দিন কাজকর্মে সহায়তার জন্য ওই ৭২ জন সাধারণ কয়েদি নিয়োজিত।  

কারাগার সম্পর্কিত একটি সূত্র জানায়, কেরানীগঞ্জের এই বিশেষ কারাগারটির ব্যবহার প্রথমে ছিল অন্য রকম। পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মন্ত্রী-নেতারা খালি পড়ে থাকা নারী কারাগারটি ধোয়া-মোছার নাম করে রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনের হুমকি দিতেন। এমনকি সাবেক আওয়ামী প্রধান শেখ হাসিনা প্রকাশ্যে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন— ‘বেশি বাড়াবাড়ি করলে আবার কারাগারে ঢুকিয়ে দেব। ’ তার সেই বক্তব্যের পরপরই তৎকালীন কারা কর্তৃপক্ষ ওই খালি পড়ে থাকা নারী কারাগারে ধোয়া-মোছার কাজ শুরু করে।

কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সেই নারী কারাগার আজ রূপান্তরিত হয়েছে বিশেষ কারাগারে— যেখানে বন্দি রাখা হয়েছে আওয়ামী সরকারের সাবেক মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে শীর্ষ নেতাদের। সেখানে ডিভিশনপ্রাপ্তরা হলেন- ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী; সাবেক হওয়া আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন, সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এবি তাজুল ইসলাম, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম, ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার, দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান, বেসামরিক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন, উপমন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব, এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু।

কেরানীগঞ্জ বিশেষ কারাগারের একটি সূত্র বাংলানিউজকে জানিয়েছে, কারাগারে হাজতি বা কয়েদিদের ডিভিশনের বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে আদালতের আদেশের পরে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের (ডিসি) কাছে আবেদন ও আদেশের কপি পাঠানো হয়। তিনি সরকারের পক্ষে, বন্দি কোন শ্রেণির ডিভিশন পাবেন সেই সিদ্ধান্ত দেন। কাগজ-কলমে নির্দেশনা মোতাবেক কারা বিধি অনুযায়ী ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়।

যেমন— সাধারণ বন্দিদের খাবারের মান এবং ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিদের খাবারের মান প্রায় কাছাকাছি হলেও স্পষ্ট কিছু পার্থক্য রয়েছে। ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিদের জন্য সাধারণ বন্দিদের তুলনায় উন্নত মানের খাবার সরবরাহ করা হয়, পরিমাণেও থাকে বেশি। তাদের জন্য আলাদা রান্নার ব্যবস্থাও থাকে।

আরও পড়ুন: ১১৩ সিসি ক্যামেরার ‘বিশেষ কারাগারে’ আনিসুল-সালমানরা

সাধারণ বন্দিদের সকালের খাবারে দেওয়া হয় রুটি, সবজি ও গুড়। দুপুরে থাকে ভাত, ডাল ও সবজি। আর রাতে পরিবেশন করা হয় ভাত, ডাল, সঙ্গে মাছ বা মাংস। তবে ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিদের জন্য নিয়ম অনুযায়ী খাবারের তালিকায় আলাদা আয়োজন থাকে। যেমন, তাদের জন্য মাছ-মাংসের রান্নার ধরন আলাদা হয়, পরিমাণও তুলনামূলক বেশি। ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিরা দুপুর ও রাতে প্রতিবারই ১৫০ গ্রাম করে মাছ বা মাংস পান, বিপরীতে সাধারণ বন্দিদের জন্য বরাদ্দ থাকে মাত্র ৩৬ গ্রাম।

আবাসনের ক্ষেত্রেও বড় ধরনের ভিন্নতা দেখা যায়। সাধারণ বন্দিদের নির্দিষ্ট ভবনের ওয়ার্ডে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। সেখানে পাকা ফ্লোরে কম্বল বিছিয়েই রাত কাটাতে হয় তাদের। অন্যদিকে ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিদের জন্য বরাদ্দ থাকে আলাদা কক্ষ। কেউ একা বা সর্বোচ্চ কয়েকজন মিলে সেখানে থাকতে পারেন। ঘরে থাকে খাট, একটি ম্যাট্রেস, দুটি চাদর, একটি চেয়ার ও একটি টেবিল। প্রতিদিন তাদের জন্য একটি পত্রিকা সরবরাহ করা হয়, সঙ্গে দেওয়া হয় দুধ-চিনি মেশানো চা।

ডিভিশন সুবিধার ব্যাপারে আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশের কারাগারে আদালতের নির্দেশে সাজাপ্রাপ্ত কিংবা বিচারাধীন মামলার আসামিদের মধ্যে অনেকেই তাদের সামাজিক মর্যাদা ও অবস্থানের ভিত্তিতে ডিভিশন-সুবিধা পান। তবে বিধি অনুযায়ী ডিভিশনপ্রাপ্ত সবার সুবিধা এক রকম নয়। কারা কোন ক্যাটাগরিতে পড়বেন এবং কী ধরনের সুবিধা ভোগ করবেন— সেটি আইনে সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারিত।

তারা উদাহরণ দিয়ে বলেন, একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি যে সুযোগ-সুবিধা পাবেন, তা কোনো অধ্যাপক পাবেন না। যদিও দুজনই নিয়ম অনুযায়ী ডিভিশন সুবিধাভুক্ত বন্দি হিসেবে গণ্য হবেন।

কেরানীগঞ্জ বিশেষ কারাগার সূত্রে জানা গেছে, কারাগারের ভেতরের দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব মূলত সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদিদের ওপরই ন্যস্ত থাকে। আদালত যখন কোনো বন্দিকে সশ্রম সাজা দেন, তখন তাকে কোনো না কোনো কাজ করা বাধ্যতামূলক হয়ে যায়।

তবে এসব কাজ কেবল শাস্তির অংশ নয়; এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে কিছু বাড়তি সুযোগ-সুবিধাও। নিয়মিত কাজ করা কয়েদিরা সাধারণ বিচারাধীন বন্দিদের তুলনায় বেশি পরিমাণে খাবার, বিশেষত ভাত ও রুটি পান। শুধু তাই নয়, ভালো ব্যবহার ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ সম্পাদন করলে একজন কয়েদির সাজার মেয়াদ চার ভাগের এক ভাগ পর্যন্ত মওকুফ হওয়ার সুযোগও থাকে। ফলে বন্দিদের কাছে কাজ করা যেমন দায়িত্ব, তেমনি তা মুক্তির দিকেও এগিয়ে যাওয়ার একটি সুযোগ।

কারাগারে কাজ বণ্টনের ক্ষেত্রে বন্দির শারীরিক সক্ষমতা, মানসিক প্রস্তুতি এবং ব্যক্তিগত দক্ষতা বিবেচনায় নেওয়া হয়। কেউ যদি শিক্ষিত হন, তাহলে তাকে কারাগারের দাপ্তরিক কাজে যুক্ত করা হয়। অন্যদিকে সাধারণ কয়েদিরাও যদি স্বেচ্ছায় কাজ করতে চান, তবে নির্দিষ্ট নিয়মের আওতায় তাদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

কারাগারের কাজের ধরনও নানা রকম— রান্নাঘরের কাজ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, চাষাবাদ, কিংবা বিভিন্ন জরুরি কার্যক্রম। সব মিলিয়ে এই কাজগুলো বন্দিদের জীবনযাপনে একদিকে শাস্তির অংশ হলেও, অন্যদিকে তা হয়ে ওঠে মুক্তির আশা ও আত্মশুদ্ধির এক মাধ্যম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও সমাজ-অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বাংলানিউজকে বলেন, ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট সরকার তার নিজস্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবহার করে আবু সাইদ, মুগ্ধসহ অসংখ্য আন্দোলনকারীকে হত্যা করেছে, আহত করেছে হাজার হাজার মানুষকে। বর্তমানে তারা কেরানীগঞ্জ কারাগারে চার দেয়ালের ভেতরে বন্দি থাকলেও ডিভিশন অনুযায়ী উন্নতমানের খাবার ও বিশেষ সুবিধা ভোগ করছে। এখন প্রশ্ন হলো— তারা যদি রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে ডিভিশন পেয়ে থাকে, তবে তা কতটা যৌক্তিক? কারণ, তারা কেউ কেউ নিয়ম অনুযায়ী মন্ত্রী-এমপি বা শিল্পপতি ভিআইপি পরিচয়ে ডিভিশন পেলেও, মামলার প্রেক্ষাপটে তো তারা গণহত্যার আসামি। ’

তৌহিদুল হক আরও বলেন, ‘মামলা অনুযায়ী তারা হাজার হাজার মানুষ হত্যার দায়ে অভিযুক্ত, অর্থাৎ গণহত্যাকারী। তাদের বিচার চলছে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে। তাই সরকারের উচিত দ্রুত বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা— আসলে ডিভিশন সুবিধা কারা পাচ্ছে এবং তা কতটা ন্যায্য। ’

এ বিষয়ে কারা মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মোহাম্মদ মোতাহার হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘কারা বিধি অনুযায়ী ডিভিশনপ্রাপ্ত বিশেষ বন্দিদের নিয়ম অনুযায়ী কিছুটা সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। বাড়তি সুবিধা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ডিভিশনপ্রাপ্তদের কি কি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া দরকার সেটি জেল বিধিতে উল্লেখ আছে। তাদের সেভাবেই সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।

এজেডএস/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।