ঢাকা: সংঘবদ্ধভাবে অনলাইনে প্রতারণা করে বিপুল অংকের অর্থ হাতিয়ে নেওয়া, হুন্ডি কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে অর্জিত ৩৪ কোটি টাকার মানিলন্ডারিং অভিযোগে নয়জনের নাম উল্লেখ করে আরও অজ্ঞাতনামা ৭-৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে সিআইডি।
বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) এ তথ্য নিশ্চিত করেন সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার জসিম উদ্দিন খান।
এজাহারনামীয় আসামিরা হলেন আরিফুল ইসলাম রিফাত (২৩), মো. ইমরান হোসেন, (৩০), মো. নুরে আলম (৩৮), মোছা. লিলি আক্তার (৫৫), রুমি আক্তার (৩৬), আব্দুল কাদির জিলানি (৪০), মুহা. নেয়ামতুল্লাহ (৩০) ও মো. রিয়াদ (২৫)
চক্রের প্রধান হোতাদের সবাই একই পরিবারের সদস্য। চক্রের প্রধান আরিফুল ইসলাম রিফাত, তার মা লিলি আক্তার, দুই বোন রিমি আক্তার ও রুমি আক্তার এবং বোনের স্বামী আবদুল কাদির জিলানী সরাসরি প্রতারণার পুরো কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন।
সিআইডির প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা যায়, এই প্রতারক চক্র প্রথমে টেলিগ্রামে বিভিন্ন মানুষের কাছে ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের প্রস্তাব দিতো। পরে কেউ সম্মত হলে তাকে এমন একটি টেলিগ্রাম গ্রুপে যুক্ত কর হতো যেখানে ওই টার্গেটকৃত ব্যক্তি ছাড়া বাকি সব আইডি ভুয়া।
সেই গ্রুপে ভুয়া আইডির পজিটিভ রিভিউ দেখে ভিকটিমরা ফ্রিল্যান্সিং কাজে সম্মত হলে তাদের প্রথমে সাধারণ কিছু কাজ দেওয়া হতো এবং প্রথমবার ৮-১০ হাজার টাকা প্রদান করা হতো। এতে ভুক্তভোগীর আস্থা অর্জন করা হতো, যেন মনে হয় সব ঠিকঠাক চলছে। একবার আস্থা তৈরি হলে তারা বড় প্রজেক্টের প্রলোভন দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতো।
চক্রটি শুধু অনলাইন প্রতারণাতেই সীমাবদ্ধ থাকতো না। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে দরিদ্র ও নিরক্ষর মানুষদের টার্গেট করত। তাদের সরকারি ভাতার প্রলোভন দেখিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করা হতো।
এই পরিচয়পত্র ব্যবহার করে ভুয়া ব্যাংক ও মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (বিকাশ, নগদ) অ্যাকাউন্ট খোলা হতো। অনেক সময় মানুষ জানতোও না যে তার নামে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। এরপর এই অ্যাকাউন্টগুলো ব্যবহার করা হতো টেলিগ্রামে প্রতারণা, অনলাইন জুয়া ও হুন্ডির লেনদেনে। ভুক্তভোগীর জমা অর্থ ধীরে ধীরে চক্রের মূল সদস্যদের কাছে স্থানান্তরিত হতো।
চক্রটি দেশের অসাধু ব্যবসায়ী ও ঘুষ দুর্নীতির অর্থও হুন্ডি ও ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে বিদেশে পাঠাত। অর্থ স্থানান্তরের প্রক্রিয়াটি ছিল অত্যন্ত জটিল। চক্রটি একাধিক ভুয়া এবং পরিবারের সদস্যদের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ছোট ছোট লেনদেনের মাধ্যমে প্রকৃত উৎস লুকিয়ে রাখত। এতে বাইরের কেউ সহজে বুঝতে পারত না কতটা অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। পরিবারের সদস্য ও সহযোগীরা একে অপরের অ্যাকাউন্টে পরপর অর্থ পাঠাত, যাতে সবকিছু খুবই স্বাভাবিক দেখায়।
সবশেষে, চক্রটি অর্জিত অর্থ ডিজিটাল হুন্ডি ও ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করত। তারা বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ডলার বা ক্রিপ্টো ক্রয় করে তা বিদেশি ঠিকানায় স্থানান্তর করত। এক কথায় চক্রটি আস্থা তৈরি করা, বড় প্রজেক্টের প্রলোভন দেখানো, ভুয়া অ্যাকাউন্ট খোলা এবং ক্রিপ্টো বা হুন্ডি ব্যবহার; সব মিলিয়ে তারা মানুষের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার একটি সুসংগঠিত ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল।
প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগীদের অভিযোগ পেয়ে তাদের দেওয়া তথ্য ও তার ব্যবহৃত এমএফএস/ব্যাংক হিসাব পর্যালোচনা করে চক্রটির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সত্যতা পাওয়ার পর ৯ জনসহ অজ্ঞাতনামা ৭/৮ জনের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় মামলা করে সিআইডি।
বর্তমানে ঘটনাটির তদন্ত কার্যক্রম ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট পরিচালনা করছে। অপরাধের পূর্ণাঙ্গ তথ্য উদঘাটন, অপরাপর সদস্যদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করার স্বার্থে সিআইডির তদন্ত ও অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
এজেডএস/এইচএ/