ঢাকা, বুধবার, ২৯ আশ্বিন ১৪৩২, ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ২২ রবিউস সানি ১৪৪৭

জাতীয়

স্ত্রীকে ফোন দিয়ে স্বামীর আর্তনাদ— আগুন, বাঁচাও; তারপর থেকে খোঁজ নেই

মিরাজ মাহবুব ইফতি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:০২, অক্টোবর ১৪, ২০২৫
স্ত্রীকে ফোন দিয়ে স্বামীর আর্তনাদ— আগুন, বাঁচাও; তারপর থেকে খোঁজ নেই নিখোঁজ নাজমুলের স্ত্রী। ছবি: বাংলানিউজ

রাজধানীর মিরপুরের শিয়ালবাড়ির আগুনে পুড়ে যাওয়া পোশাক কারখানার মেশিন অপারেটর ছিলেন নাজমুল ইসলাম। প্রতিদিনের মতো মঙ্গলবারও (১৪ অক্টোবর) তিনি যথাসময়ে কাজে যোগ দিয়েছিলেন।

আগুন লাগার পর থেকে তার খোঁজ মিলছে না।  

এর আগে মঙ্গলবার বেলা ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে শিয়ালবাড়ির একটি কেমিক্যাল গোডাউন ও একটি গার্মেন্টসে আগুন ধরে যায়। এ ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ১৬ জনের। নিখোঁজও হন অনেকে। তাদেরই একজন নাজমুল ইসলাম।

জানা গেছে, আগুন লাগার পর স্ত্রীকে ফোন দিয়েছিলেন নাজমুল। মোবাইলের এ প্রান্ত থেকে শুধু বলেছেন, আগুন আগুন, বাঁচাও। তারপর লাইন কেটে যায়। তারপর থেকে নাজমুলের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না।  

নিখোঁজ নাজমুল ইসলামের স্ত্রী এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, আমার সাথে কথা হওয়ার পর থেকে স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতেসি না। ঢাকা মেডিকেল, ইবনে সিনা, ইসলামি মেডিকেলসহ আশপাশের সব হাসপাতালে গিয়া খোঁজ করসি। কোথাও পাইতেসি না। গার্মেন্টস মালিককে কল করসিলাম। তিনি বলসিলো, কেউ মরে নাই; সবাই নিরাপদে আসে। কিন্তু আমি তো আমার স্বামীরে খুঁইজা পাইতেসি না।  

কান্না করতে করতে তিনি বার বার বলছিলেন, ওই যে, যখন আগুন লাগে তখন ফোন দিয়া বলসিলো তারে বাঁচাইতে। ওইটাই ছিল শেষ কথা। এরপর আর কোনো যোগাযোগ নাই।  

এদিকে আগুনের ঘটনায় এখনও বহুজনের খোঁজ না মেলায় তাদের স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে শিয়ালবাড়ি ও আশপাশের সড়ক। কেউ হাসপাতালে দৌড়াচ্ছেন, কেউ ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের কাছে ধরনা ধরছেন।

মো. শফিকুল ইসলাম হাতে ভাগ্নি মাহিরার (১৪) ছবি নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন আগুনে পুড়ে যাওয়া ভবনের সামনে। চোখে মুখে অশ্রু আর আতঙ্ক। তিনি বলেন, আমার ভাগ্নি মাহিরা গার্মেন্টসের তৃতীয় তলায় কাজ করতো। আগুন লাগার পর থেকে খুঁজতাসি। কোনো হাসপাতালেও পাই নাই। ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা কইসে ধৈর্য ধরতে।

নিখোঁজ নারগিস আক্তারের বড় বোন লাইজু বেগম জানান, আমার বোন সকাল পৌনে আটটায় কাজে আসে। সকাল ১১টার দিকে খবর পাই আগুন লাগসে। তার এক সহকর্মীর সঙ্গে কথা হইলে সে কইসে আগুন লাগার পর ভিতর থাইকা কেই বাইর হইতে পারে নাই। আমার বোনের কোনো খোঁজ পাইতাসি না।  

সরেজমিনে দেখা যায়, শিয়ালবাড়ির ৩ নম্বর সড়কের দক্ষিণ পাশে শাহ আলম কেমিক্যালের দুইতলা গুদামটি আগুনে সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। উপরের তলায় ছিল টিনের ছাউনি। আগুনের সূত্রপাত হয় এই গুদাম থেকেই। বিস্ফোরণের পর মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাশের চারতলা পোশাক কারখানায়। দুই ভবনের মাঝখানে ছিল সরু একটি রাস্তা। ফলে ফায়ার সার্ভিসের আগুন নির্বাপণের কাজ ব্যাহত হয়।  

ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে তারা আগুন লাগার খবর পেয়ে ১১টা ৫৬ মিনিটে তাদের প্রথম ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। প্রাথমিকভাবে পাঁচটি ইউনিট কাজ শুরু করে; পরে আরও সাতটি ইউনিট যোগ দেয়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হঠাৎ করে গার্মেন্টসে বিস্ফোরণ ঘটে, তারপর মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাশের কেমিক্যাল গুদামে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। পাশে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকরাও আগুন নেভানোর কাজে অংশ নেয়।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. তাজুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন দাহ্য রাসায়নিক থাকার কারণে কেমিক্যাল গুদামের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে আমাদের দীর্ঘ সময় লেগেছে। লাশগুলো অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ডিএনএ টেস্ট ছাড়া তাদের শনাক্ত করা সম্ভব নয়। চেহারা দেখে কিংবা অন্য কোনোভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।

এমএমআই/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।