খুলনার পাইকগাছার দেলুটি থেকে ফিরে: ষাটোর্ধ্ব কুলসুম বেগম শুকনো মাটির ঢ্যালা গুলিয়ে কাদা তৈরি করে ঘর লেপছেন। দুপুরের সূর্যের তপ্ত আলো তাকে ক্লান্ত করতে পারছে না।
খুলনার পাইকগাছা উপজেলার দেলুটি ইউনিয়নের নোলির চর গ্রামে মাটির দেয়ালের ঘর লেপার সময় কথা হয় কুলসুম বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, কয়দিন গেলেই ধান-পান উঠবো। তার আগে ঘর-দুয়ার লেপে ঠিক কইরে রাখতেছি। এরপর তো আর সময় পাবো না।
মাটির ঘরটির বয়স কত জানতে চাইলে কুলসুম জানান, ঘরটি তার শ্বশুরের তৈরি। বয়স কত হবে তা তার জানা নেই।
মাটির ঘরের সুবিধা সম্পর্কে তিনি বলেন, আমাগে গ্যারামে (গ্রাম) কারেন (বিদ্যুৎ) নাই। আমরা ফ্যান চালাইতে পারি না। গরমে মাটির ঘর আমাগে ঠাণ্ডা দেয়, আর শীতে দেয় গরম।
একই গ্রামের আব্দুল কুব্দুস (৬৫) জানান, মাটির দেয়ালের তাদের ঘরের বয়স দু’শ বছরের বেশি। ঝড়-বৃষ্টি থেকে বাঁচার পাশাপাশি তীব্র গরম ও প্রচণ্ড শীতে বসবাস উপযোগী মাটির ঘর। যার কারণে মাটির ঘরকে গরিবের এসি বলা হয়।
পাইকগাছার ২২নং পোল্ডারের দেলুটি ইউনিয়নের দারুণ মল্লিক এলাকার রমেশ শীল বলেন, এ এলাকার ৯৯ ভাগ ঘর মাটির দেয়ালের। আধুনিকতার ছোঁয়া আর কালের আবর্তে অনেক গ্রামে ঐতিহ্যবাহী মাটির ঘর বিলুপ্ত হয়ে গেলেও এখানে এখনও মাটির ঘর রয়েছে।
তিনি জানান, মাটির ঘর শীত ও গরম মৌসুমে আরামদায়ক। তাই আরামের জন্য গ্রামের দারিদ্র্য ক্লিষ্ট মানুষের পাশাপাশি অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারও মাটির ঘরে বসবাস করেন।
দেলুটি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, এসব মাটির দেয়ালের ঘর যেন গরিব জনগোষ্ঠীর শান্তির নীড়। খড়কুটা, নাড়া, টালী কিংবা টিন দিয়ে ছাউনি দেওয়া এসব ঘরে বাঁশের কঞ্চি ও ধইনচ্যা দিয়ে জানালা তৈরি করা হয়েছে। যা দেখতে খুবই সুন্দর। প্রাকৃতিকভাবে বসবাসের জন্য বেশ মনোমুগ্ধকর।
স্থানীয়রা জানান, এই এলাকায় শতশত বছর ধরে মাটির ঘরের প্রচলন রয়েছে। সাধারণত জমি, নদী অথবা পুকুরের এঁটেল মাটি দিয়ে এসব ঘর তৈরি করা হয়। পরিচ্ছন্ন মাটির সঙ্গে পানি মিশিয়ে কাদায় পরিণত করে ২০-৩০ ইঞ্চি চওড়া দেয়াল তৈরি করা হয়।
প্রতিবারে এক-দেড় ফুট উঁচু করে ক্রমে শুকিয়ে গেলে কাঠ বা বাঁশের সিলিং তৈরি করে তার ওপর খড়, টালী বা টিন দিয়ে ছাউনি দেওয়া হয়। প্রতিটি ঘর তৈরিতে সময় লাগে দু’তিন মাস।
এসব মাটির ঘর অনেক সময় দোতলা পর্যন্ত করা হয়। গৃহিনীরা মাটির দেয়ালে বিভিন্ন রকমের আলপনা এঁকে ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেন।
পাইকগাছার দেলুটি ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান সমরেশ হালদার বাংলানিউজকে বলেন, এই এলাকার মানুষ বাপ-দাদার ঐতিহ্যবাহী মাটির ঘর টিকিয়ে রেখেছেন। মাটির সহজলভ্যতা, প্রয়োজনীয় উপকরণের প্রতুলতা আর শ্রমিক খরচ কম হওয়ায় দরিদ্র মানুষরা মাটির ঘর তৈরি করেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৫০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০১৫
এমআরএম/জেডএস