সারিয়াকান্দি (বগুড়া): বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার যমুনা নদীর চরাঞ্চলের মানুষকে এখন বিভিন্ন রোগ ও দুর্ঘটনায় চিকিৎসা সেবা নিয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হয়না।
দুর্গম এ এলাকার চরগুলোতে এখন সহজেই মিলছে চিকিৎসা সেবা।
প্রতিদিন বিভিন্ন ধরণের রোগে ভোগা প্রায় দুই শতাধিক মানুষকে আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে চরে ভাসমান লাইফবয় ফ্রেন্ডশিপ নামে একটি জাহাজে ভাসমান হাসপাতালে।
এদিকে, দুর্গম চরে দরিদ্র মানুষদের মধ্যে এ উদ্যোগ ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। ভাসমান এ হাসপাতালে চরের দূর-দূরান্ত থেকে এসে সেবা নিচ্ছেন অনেকে।
উপজেলা সদরের কালিতলা হার্ট পয়েন্টের নৌঘাট থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্ব এলাকায় প্রবাহমান যমুনা নদীতে ভাসমান অবস্থায় সেবা দিচ্ছে লাইফবয় ফ্রেন্ডশিপ জাহাজের এ হাসপাতাল।
সুন্দর পরিবেশ ও পরিপাটি করে সুসজ্জিত জাহাজে চিকিৎসা নিতে প্রতিদিন চরের বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি আশপাশের গ্রামের অবহেলিত দরিদ্র রোগীরাও আসছেন।
তবে এসব রোগীদের জন্য নামমাত্র হিসেবে পুরুষদের জন্য ১০ টাকা ও নারীদের জন্য ৫ টাকার টিকিটের বিনিময়ে নাম নিবন্ধন করা হয়। পরে নিবন্ধন অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া হয়।
তবে প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা নিতে ভিড় করলেও মান ও জনবলের কারণে ১৭০ জনের বেশি রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয় না।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, জাহাজে চিকিৎসৎক এবং অন্যান্য জনবল কম হওয়ায় রোগীরা চিকিৎসা নিতে না পেরে দিনের পর দিন অপেক্ষার পর চিকিৎসকের সিরিয়াল পাচ্ছেন।
৯ নভেম্বর বিকেলে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পরের দিনের সিরিয়ালের জন্য সারিবদ্ধভাবে বালুচরে শুয়ে, বসে অপেক্ষায় রয়েছেন বিভিন্ন বয়সী শতাধিক রোগী।
জাহাজে গিয়ে দেখা যায়, নির্ধারিত রোগীদের বিভিন্ন রকমের রোগের চিকিৎসা ও অপারেশনের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। কেউ চোখের ছানি অপারেশন, কারো ঠোঁট কাটা, তালু কাটা অপারেশন, আবার কাউকে প্রস্তুত করা হয়েছে প্লাস্ট্রিক সার্জারির জন্য।
ভাসমান জাহাজ হাসপাতালে কর্মরত তৌহিদুর রহমান জানান, স্পেনের বারাকিউর ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে ও লাইফবয়ের সৌজন্যে পরিচালিত এ হাসপাতালে মোট জনবল রয়েছে ৩৫ জন। এদের মধ্যে ৩ জন মেডিকেল সহকারী, ১২ জন প্যাথলজিস্ট, ১ জন নার্স, ১ জন ডেন্টিস্ট রয়েছেন।
দেশের খ্যাতিমান জেনারেল ফিজিশিয়ান ডা. আজম ও ডা. রতন কুমার খিসা চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। এছাড়াও স্পেন এবং জার্মানি থেকে আসা ৪/৫ জন বিষেষজ্ঞ চিকিৎসক রোগীদের অপারেশন কার্যক্রম ও চিকিৎসা সেবা প্রদান করছেন। তবে বিদেশি চিকিৎসকরা সি-পেইন যোগে সকালে ঢাকা থেকে আসেন। আবার চিকিৎসা শেষ করে দিনশেষে তারা ঢাকায় ফিরে যান।
সূত্র জানায়, উপজেলার চালুয়াবাড়ী ইউনিয়নের শিমুলতাইড় চরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে আড়াই মাস চিকিৎসাসেবা শেষে গত ২০ অক্টোবর সদর ইউনিয়নের গজারিয়া চরে জাহাজটি নোঙর করে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে।
জাহাজের রোগীদের জরুরিভাবে জেলা সদরে চিকিৎসার প্রয়োজন হলে তাদের নেওয়ার জন্য দুটি বিশেষ অ্যাম্বুলেন্স সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
অপারেশনের পর জাহাজের কেবিনে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা রোগীদের পর্যবেক্ষণে রাখার পর যমুনার পাড়ে নির্মিত টিনশেড ঘরে ৩/৪ দিন রেখে সেবা দেওয়া হয়। পরে মোটামুটি সুস্থ হলে রোগীরা বাড়ি ফিরে যান। তবে ওষুধ ও খাবারের ব্যবস্থা রোগীর নিজেকেই করতে হয়।
সোনাতলা উপজেলার বালুয়াহাটা গ্রাম থেকে এসেছেন গরিব কৃষক জাকিউল ইসলাম। তিনি জানান, তার ১১ বছর বয়সী মেয়ে তৃঞ্চার বয়স যখন ২ বছর, তখন তার শরীরের কিছু অংশ আগুনে পুড়ে যায়।
মেয়ের প্লাস্ট্রিক সার্জারি করাতে প্রায় ৩ লাখ টাকা খরচের কথা জানিয়েছেন চিকিৎসক। কিন্তু এখানে মাত্র ৫ টাকার টিকিটে ভর্তি হওয়ার পর বিদেশি চিকিৎসকরা বিনামূল্যে প্লাস্ট্রিক সার্জারি করে দিয়েছেন।
দারুনা চরের বৃদ্ধা করিমন বেওয়া(৬৫) দীর্ঘদিন চোখে ছানি পড়া রোখে ভুগছেন। খবর পেয়ে তিনি এসেছেন এখানে। চোখের ছানি অপারেশনের পর এখন তিনি সুস্থ।
বাগবেড় গ্রামের রহমত আলীর স্ত্রী রিনা বেগম (৩৬) জরায়ু রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর মৃত্যুর প্রহর গুণছিলেন। জাহাজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছেন।
ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের সারিয়াকান্দি অফিসের সুপারভাইজার মতিউর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, উপজেলায় চরাঞ্চলের দরিদ্র মানুষের জন্য এ চিকিৎসা সেবা অব্যাহত থাকবে। চাহিদা অনুযায়ী রোগীদের সুযোগ-সুবিধাও বাড়ানো যেতে পারে।
তিনি জানান, আড়াই মাস পরপর এক চর থেকে আরেক চরে গিয়ে ভাসমান জাহাজ হাসপাতালটি চরের গরিব রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে।
সারিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) প্রত্যয় হাসান বলেন, জাহাজ হাসপাতালে যাতে নির্বিঘ্নে চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম পরিচালিত হয়, সেজন্য বিদেশি চিকিৎসকসহ সবার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১২১০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০১৫
এসআর