ঢাকা: দেশে বর্তমানে অ্যাসিড সন্ত্রাসের প্রবণতা কমে এলেও নির্মূল হয়নি। মামলার বিচারে দীর্ঘসূত্রতা, মানুষের নৈতিকতার পরিবর্তন ও অ্যাসিড ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে কঠোর পর্যবেক্ষণের অভাবকেই অ্যাসিড সন্ত্রাস নির্মূল না হওয়াকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের (এএসএফ) তথ্যমতে, ২০০২ সালে যেখানে সারাদেশে অ্যাসিড সন্ত্রাসের সংখ্যা ছিল ৪৯৪টি, সেখানে ২০১৪ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র ৫৯টিতে। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে অ্যাসিড সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে ৪০টি।
অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সেলিনা আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, সুনির্দিষ্ট কোনো একটি কারণে অ্যাসিড সন্ত্রাস কমেনি। কয়েকটি কারণই এর সঙ্গে জড়িত। অ্যাসিড অপরাধ দমন আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিধান, সরকার, অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনসহ অ্যাসিড সন্ত্রাস নিয়ে কাজ করা এনজিওগুলোর জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম, তৃণমূল পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ, সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুদের বিভিন্ন সেমিনারে রাখা আবেদন, অ্যাসিড ক্রয়-বিক্রয়ের বাধ্যতামূলক লাইসেন্স থাকার বিধান, আগের তুলনায় যথেচ্ছ বিক্রি বন্ধ হওয়া, সরকার ও বিভিন্ন এনজিও’র প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক সমন্বিত কার্যক্রমের কারণেই মূলত অ্যাসিড সন্ত্রাস কমে আসছে।
আইনে অ্যাসিড অপরাধের বিচার ৯০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তির কথা বলা থাকলেও এ সংক্রান্ত মামলার বিচারে দীর্ঘসূত্রতা অন্যদের অপরাধে উৎসাহিত করে। এছাড়াও অ্যাসিড ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে কঠোর পর্যবেক্ষণের অভাব, মানুষের নৈতিকতার পরিবর্তন না হওয়া ও নারী পুরুষের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাবেই অ্যাসিড সন্ত্রাস নির্মূল হচ্ছে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের লিগ্যাল সাপোর্ট বিভাগের কো-অর্ডিনেটর অনিমেষ চন্দ্র সরকার বাংলানিউজকে বলেন, সরকারি হিসাবে ২০০২ থেকে ২০১৫ সালের মে মাস পর্যন্ত অ্যাসিড সন্ত্রাসের ঘটনায় সারা দেশে মামলা হয়েছে ১ হাজার ৯৮৭টি। এসব মামলায় মোট আসামির সংখ্যা ৫ হাজার ৩১২ জন। তাদের মধ্যে ৬৩৯ জন (১২ শতাংশ) গ্রেফতার হয়েছেন। বাকি ৮৮ শতাংশ অভিযুক্ত পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছেন।
তিনি আরও জানান, ১ হাজার ১৮১টি মামলায় চার্জশিট এবং ৭৮২টি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে পুলিশ।
অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের প্রচার ও যোগাযোগ বিভাগের কো-অর্ডিনেটর একে আজাদ বাংলানিউজকে বলেন, শাস্তির বিধান কঠোর হওয়ায় আইনটির অপব্যবহারও হয়েছে। বিশেষ করে জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধে প্রতিপক্ষকে ফাঁসিয়ে জমি দখল নিতে নিজেরাই নিজের গায়ে অ্যাসিড ঢেলে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, অ্যাসিড সন্ত্রাসের ঘটনায় দায়ের করা মামলার ৩৮ শতাংশই জমিজমা ও টাকা-পয়সাকে কেন্দ্র করে বিরোধের ফলে দায়ের করা হয়েছে।
আদালতের নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ঢাকার অ্যাসিড অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন ৪/১৪ মামলায় ২০১৩ সালের ২৫ জুলাই ঢাকার মোহাম্মদপুর থানায় জনৈক আনোয়ারের বিরুদ্ধে মামলা করেন অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার এক নারী।
মামলায় বলা হয়, পূর্বশত্রুতার জের ধরে আসামি আনোয়ার ৭/৮ জন আসামির সহায়তায় ২১ জুলাই রাত ১০টায় রিকশার গতিরোধ করে তার দিকে অ্যাসিড নিক্ষেপ করেন। এতে তার পিঠ পুড়ে যায়।
বাদিনী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হলে হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার ডাক্তার ফারহানা জামান মতামত দেন, ‘মিক্সড কেমিক্যালে’ তার পিঠ পুড়ে গেছে। অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের ডাক্তার তানভীরও একই ধরনের মতামত প্রদান করেন।
কিন্তু মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার এসআই ছাইফুল ইসলাম তদন্তে দেখেন যে, আসামি আনোয়ারের সঙ্গে বাদিনীর পূর্ব বিরোধ ছিল। বাদিনী আসামির বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দিয়ে তাকে জেলহাজতে আটকে রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু বারবার আনোয়ার জামিন পেয়ে গেলে ব্যাটারির পানি নিজেই নিজের গায়ে ঢেলে আসামিকে ফাঁসিয়ে দেন।
অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার শুধু যে নারী ও শিশুরাই হচ্ছেন তা নয়। বিভিন্ন বয়সের পুরুষরাও এর শিকার হচ্ছেন। এএসএফের তথ্যমতে, ১৯৯৯ সাল থেকে চলতি বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন ৩ হাজার ৬৩৩ জন। তাদের মধ্যে ১ হাজার ৮৫১ জন নারী, ৮৭৭ জন শিশু আর পুরুষের সংখ্যা ৯০৫ জন।
বিভিন্ন বয়সের নারী, শিশু ও পুরুষরা অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হলেও ১৯ থেকে ৩৫ বছর বয়সী নারী ও পুরুষরাই এর শিকার হচ্ছেন বেশি। একে আজাদ বাংলানিউজকে বলেন, সাধারণত এসব বয়সেই প্রেম প্রত্যাখ্যান, যৌতুক, পারিবারিক বিরোধ, বৈবাহিক সমস্যা ও জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের কারণেই তারা অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হন।
অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সেলিনা আহমেদ বলেন, দেশে অ্যাসিড সন্ত্রাস কমলেও যেখানে-সেখানে প্রকাশ্যে এসিড বিক্রির কারণে পুরোপুরি নির্মূল করা যাচ্ছে না। অ্যাসিড সন্ত্রাস রোধে এটি বন্ধ করতে হবে। বিভিন্ন সভা-সেমিনার করে জনগণকে অ্যাসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সজাগ করতে হবে। সর্বোপরি মানুষের নৈতিকতার উন্নয়নই অ্যাসিড সন্ত্রাস বন্ধ করতে পারে বলেও তিনি মনে করেন।
বাংলাদেশ সময়: ২১৩৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০১৫
এমআই/এএসআর