ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

ডাণ্ডাবেড়ি পরা সাত খুনের আসামির মুখে তখনও হাসি!

আদিত্য আরাফাত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০১৫
ডাণ্ডাবেড়ি পরা সাত খুনের আসামির মুখে তখনও হাসি!

ঢাকা: বৃহস্পতিবার মধ্যরাতের আগে থেকেই শুরু হয় অপেক্ষা। স্থান ঢাকায় র‌্যাব-১ এর কার্যালয়।

আগেই জানা গিয়েছিলো নূর হোসেনকে ঢাকায় এনে র‌্যাব-১’র কার্যালয়েই নেওয়া হবে।

কিন্তু এতো ঢাকার অপেক্ষা। ওদিকে বেনাপোল সীমান্তে জিরো পয়েন্টে অপেক্ষা চলছিলো বিকেল থেকেই। শেষ পর্যন্ত রাত সাড়ে ১১টার কিছু আগে নূর হোসেনকে হস্তান্তর করলো ভারত। ফলে ধরেই নেওয়া হলো, ঢাকার অপেক্ষা প্রলম্বিত হবে পরের দিন সকাল পর্যন্ত।

বেনাপোল চেকপোস্টের জিরো পয়েন্ট দিয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ সদস্যরা নূর হোসেনকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করেন ঠিক রাত ১১টা ২০ মিনিটে। বেনাপোল পোর্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অপূর্ব হাসান জানিয়েছেন, নূর হোসেনকে হস্তান্তরকালে তিনি ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন- যশোরের পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান, নারায়ণগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মোকলেসুর রহমান, আলোচিত সাত খুন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (এসআই) মামুনুর রশিদ, যশোর ২৬ বিজিবি ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক মেজর লেয়াকত হোসেন, যশোর জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাব্বি হাশমি, বেনাপোল ইমিগ্রেশন ওসি তরিকুল ইসলামসহ স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তারা।
 
এরপর এপারের প্রস্তুতি ছিলো কিছু। সেগুলো সম্পন্ন করে রাত ১২টার পরে নূর হোসেনকে নিয়ে একটি গাড়ির বহর রওয়ানা দিলো ঢাকার উদ্দেশ্যে।

এদিকে অর্ধশত সংবাদকর্মীর নির্ঘুম রাত কাটছে র‌্যাব-১ এর কার্যালয়ে। আর সার্বক্ষণিক সতর্ক প্রহরায় প্রস্তুত সুশৃঙ্খল র‌্যাব সদস্যরা। সবারই তীক্ষ্ণ চোখ প্রধান ফটকের দিকে- কখন আসবে সেই গাড়িবহর।

এর পর শুক্রবার কাক ডাকা ভোর। ঘড়ির কাটায় সকাল ৬টা ৫০ মিনিটে ভেসে এলো সাইরেন। সবাই নড়ে চড়ে বসলেন। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে র‌্যাব সদস্যরা। ক্যামেরা সাংবাদিকদের শুরু হলো ছুটোছুটি। সাইরেন বাজাতে বাজাতেই  র‌্যাব-১ কার্যালয়ে প্রবেশ করে একটি গাড়িবহর। এ বহরেই ছিলেন নারায়ণগঞ্জে চাঞ্চল্যকর সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন।
 
বহরের সাতটি গাড়ির মধ্যে মাঝে নীল রংয়ের মাইক্রোবাসে নূর হোসেন। আর সামনে ৩টি ও পেছনে ৩টি গাড়ি।

কঠোর নিরাপত্তায় ডান-বামে ধরে র‌্যাব’র সদস্যরা তাকে গাড়ি থেকে নামালেন। শরীরে বুলেট প্রুপ জ্যাকেট। মাথায় হেলমেট। ডাণ্ডাবেড়ি পরা সাত খুনের প্রধান আসামি নূর হোসেন!

পরনে চেক শার্ট এবং প্যান্ট। মুখ ক্লিন শেভড। গাড়ি থেকে নামার পরপরই সাংবাদিকদের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। কয়েকজন টেলিভিশন সাংবাদিক তার মুখের সামনে বুম ধরলেও কোনো কথা না বলেই র‌্যাব সদস্যদের সঙ্গে সামনে হাঁটতে থাকেন।
 
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাকে খুব ধীর পায়ে হাঁটিয়ে নিয়ে গেলেন কার্যালয়ের ভেতরে।
 
এরপর র‌্যাব’র পরিচালক (আইন ও গণমাধ্যম) মুফতি মাহমুদ খান এলেন সংবাদমাধ্যমের সামনে। সকাল ৭টা ৫ মিনিটে সেখানে সাংবাদিকদের সংক্ষিপ্ত ব্রিফিংয়ে তিনি বললেন, ‘আমরা কঠোর নিরাপত্তায় তাকে ঢাকায় নিয়ে এসেছি। এখন তার মেডিকেল চেকআপ হচ্ছে। চেকআপের পর তাকে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করা হবে। ’
 
সংক্ষিপ্ত এ ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার সুযোগ ছিলো না। এ কর্মকর্তার বক্তব্যের কয়েক মিনিট পরই র‌্যাব-১ নূর হোসেনকে নারায়ণগঞ্জ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করলো।

যে নারায়ণগঞ্জে ঘটেছিলো চাঞ্চল্যকর সাত খুনের ঘটনা সেখানেই নিয়ে যাওয়া সাব্যস্ত হলো নূর হোসেনকে।

দ্রুতই নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশ্যে ছুটতে শুরু করলো পুলিশের গাড়িবহর। ঠিক একঘণ্টার মাথায় নূর হোসেনকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ লাইনসে পৌঁছালো গাড়ির বহর।

সেখানেই চলছে সাত খুন মামলার বিচারিক কার্য্যক্রম।
 
র‌্যাবের একটি সূত্র জানায়, বেনাপোল থেকে ঢাকা পর্য্যন্ত কঠোর নিরাপত্তায় তাকে আনা হয়েছে। অতি সতর্কতার সাথে মহাসড়কগুলো পাড়ি দিয়েছে নূর হোসেনের গাড়ি বহর। পুরো পথেই তার মাথায় ছিলো হেলমেট, গায়ে ছিলো বুলেট প্রুপ জ্যাকেট আর হাতে পায়ে ডান্ডাবেরি।

সূত্রটি জানায়, প্রায় ছয় ঘণ্টার পথে নূর হোসেন খুব বেশি কথা বলেননি। মাঝে মধ্যে দুয়েকটি প্রশ্ন করেছেন। র‌্যাবের সদস্যরা তার শারিরীক অবস্থার প্রতি যত্নশীল ছিলেন। সামান্য অসুস্থও ছিলেন তিনি। সেকারণেই র‌্যাব-১ কার্যালয়ে এলে তার রক্তচাপ (প্রেসার) পরিক্ষাসহ শারিরীক চেকআপ করে নারায়ণগঞ্জ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
 
গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে ভারতে চলে যাওয়ার দেড় বছরের মাথায় সেই নারায়ণগঞ্জে ফিরিয়ে নেওয়া হলো চাঞ্চল্যকর সাত খুনের মামলার প্রধান আসামি  নূর হোসেনকে।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংকরোডের ফতুল্লারলামাপাড়া থেকে নাসিক কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণ করা হয়। তিন দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীতে তাদের মরদেহ পাওয়া যায়।
 
এরপর ২০১৪ সালের ১৪ জুন কলকাতার দমদম বিমানবন্দরের কাছে কৈখালি এলাকার একটি বাড়ি থেকে দুই সহযোগীসহ নূর হোসেনকে গ্রেফতার করে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ।
 
নিহত নজরুলের মতো নূর হোসেনও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ছিলেন। পরে তাকে বরখাস্ত করা হয়।
 
সাত খুনের মামলায় র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, আরিফ হোসেন ও এম এম রানাসহ ২২ জন কারাগারে রয়েছেন। পলাতক রয়েছেন র‌্যাবের আট সদস্যসহ ১৩ আসামি।
 
বাংলাদেশ সময়: ১২৪২ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০১৫
এডিএ/এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।