ঢাকা: ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল। রাজধানী ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জ শহরের কাছ থেকে পৌর কাউন্সিলর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ ৭ জনকে ধরে নিয়ে যান র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) কতিপয় সদস্য।
নানামুখী সফলতা ও কিছু ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে সামনের দিকে দ্রুত ধাবমান বাংলাদেশে সম্প্রতিকালের সবচেয়ে আলোচিত অপরাধ ছিল এটি। এ শতাব্দীর সবচেয়ে নিঃকৃষ্ট ও ঘৃণতম অপরাধ হিসেবেও বিবেচিত হতে থাকে নারায়ণগঞ্জ সাত খুনের ঘটনা।
অল্প সময়ের মধ্যেই জানা যায়, যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে সাধারণ মানুষের জান-মালের নিরাপত্তার দায়িত্ব ন্যাস্ত, সেই বাহিনীরই কতিপয় সদস্য’র সরাসরি অংশ গ্রহণে সাত জন নিরাপরাধ মানুষ খুন হন। তদন্তেও প্রমাণ হয় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সদস্যরা সরাসরি এই খুনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে জানা যায় ঘুষ দিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। আর তাতেই সামনে আসে নারায়ণগঞ্জের ত্রাস হিসেবে খ্যাত নূর হোসেনের নাম। তবে এরই মধ্যে দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারত চলে যান নূর হোসেন।
তদন্ত শেষ হলেও মামলা ধীর গতি নিয়ে ভিক্টিম পরিবার ও সাধারণ মানুষেষর মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা দানা বাঁধতে থাকে। একজন মন্ত্রীর জামাতা ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকায় ওপর মহল থেকে মামলার গতি স্লো করে দেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ ওঠে। কিন্তু ঘটনার সাড়ে ১৮ মাস পর বৃহস্পতিবার (১২ নভেম্বর) স্থলপথে ভারত থেকে মামলার প্রধান আসামী নূর হোসেনকে ফিরিয়ে আনার পর ভিক্টিম পরিবার ও সাধারণ মানুষের ক্ষোভ প্রশমন এবং সমালোচকদের মুখ বন্ধের প্রয়াস দেখাল সরকার।
ঘটনা পরম্পরার দিকে দৃষ্টি ফেরালে দেখা যায়, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংরোড থেকে পৌর কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাত জনকে অপহরণ করে র্যাব-১১ এর কতিপয় বিপথগামী সদস্য। এর তিন দিন পর সাত জনেরই মৃতদেহ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভেসে ওঠে।
এই ঘটনায় আরেক কাউন্সিলর নূর হোসেনকে প্রধান আসামি করে নিহত কাউন্সিলর নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম ফতুল্লা মডেল থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। অন্যদিকে আইনজীবী চন্দন সরকারের মেয়ে জামাই বিজয় কুমার পাল একই থানায় আলাদা একটি হত্যা মামলা করেন। নারায়ণগঞ্জ জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ওপর মামলাটির তদন্তভার ন্যাস্ত হয়। তদন্ত রিপোর্টে অভিযোগ করা হয়, কাউন্সিলর নূর হোসেনের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ে তার প্রতিপক্ষকে খুন করেছে র্যাব।
মামলা দায়েরের পরপরই পুলিশ র্যাব-১১ এর সাবেক অধিনায়ক তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, কর্মকর্তা মেজর (অব) আরিফ হোসেন ও লে. কমান্ডার (অব) এম এম রানাকে গ্রেপ্তার করে। তাঁরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। মামলার আরেক আসামি নূর হোসেন পালিয়ে ভারতে গেলেও সেখানে ধরা পড়েন।
দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় প্রধান আসামি নূর হোসেন ছাড়াও এখন পর্যন্ত পুলিশ ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এদের মধ্যে র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ মোট ১২ জন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
জেলা গোয়েন্দা পুলিশের সূত্র থেকে জানা যায়, অপহরণ, খুন ও লাশ গুমের সঙ্গে যুক্ত এবং ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন র্যাব-১১ এর এমন ২৩ সদস্যের নাম ও পরিচয় তাঁদের হাতে রয়েছে। অবশ্য তিন র্যাব কর্মকর্তারসহ ১২ জনের স্বীকারোক্তি, প্রত্যক্ষদর্শী, নূর হোসেনের দেহরক্ষী ও ঘনিষ্টজনদের স্বীকারোক্তিতে এখন পর্যন্ত ৩৮ জনের নাম এসেছে। এর মধ্যে ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
পুলিশি তদন্তের পাশাপাশি আলোচিত এ ঘটনা তদন্তের জন্য হাইকোর্টের নির্দেশে গত বছর ৭ মে একটি প্রশাসনিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শাহজাহান আলী মোল্লা নেতৃত্বাধীন এ তদন্ত কমিটি একে একে ভিক্টিমদের পরিবার, প্রত্যক্ষদর্শী, নারায়ণগঞ্জের আলোচিত রাজনীতিক শামীম ওসমান, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরশনের নির্বাচিত মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী এবং র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসানকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
এদিকে সাত খুনের মামলার তদন্ত শেষ হয়ে গেলেও শিগগিরই অভিযোগপত্র দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা তদন্তকারী সংস্থাগুলোর নেই। সবকিছু শনাক্ত হলেও মামলা নিয়ে কিছুটা ধীরে চলার নির্দেশ রয়েছে ওপর মহলের। কবে এর তদন্ত শেষ হবে সে ব্যাপারে কেউ কিছু বলতে পারছেন না- এমন খবর চারদিকে চাউর হতে থাকলে গত বছর ১ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম এইচ এম শফিকুল ইসলাম‘র আদালত ২২ জানুয়ারির মধ্যে চার্জশিট প্রদানের নির্দেশ দেন।
ঘটনার প্রায় এক বছর পর গত ৮ এপ্রিল র্যাবের সাবেক অধিনায়ক তারেক সাঈদ, দুই কর্মকর্তা আরিফ হোসেন ও এম এম রানা এবং আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেনসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়।
নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম চাঁদনী রূপমের আদালতে এ চার্জশিটটি দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও নারায়ণগঞ্জ জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মামুনুর রশিদ মণ্ডল।
এদিকে ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যে র্যা-১১ এর সাবেক অধিনায়ক তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, কর্মকর্তা মেজর (অব) আরিফ হোসেন ও লে. কমান্ডার (অব) এম এম রানাকে গ্রেপ্তার করা হলেও ভারতে পালিয়ে যাওয়ায় নূর হোসেন থেকে যান ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
কিন্তু গত বছর ১৭ জুন রাতে কলকাতার দমদম বিমানবন্দরের অদূরে কৈখালির ইন্দ্রপ্রস্থ আবাসন এলাকা থেকে দুই সঙ্গীসহ নূর হোসেনকে গ্রেপ্তার করে এটিএস এবং বাগুইহাটি থানার পুলিশ।
গ্রেপ্তারের পরের দিন উত্তর চব্বিশ পরগনার বারাসাতের বিচার বিভাগীয় হাকিমের আদালতে তোলা হলে তাদের আট দিনের পুলিশি রিমান্ড দেওয়া হয়। রিমান্ডের সময় নূর হোসেন নিজেকে নির্দোষ দাবি করে। বাঁচাতে তাকে সীমান্ত পার হতে হয়েছে বলেও জানান।
এর পর শুরু হয় ভারত থেকে নূর হোসেনকে দেশে ফেরানোর নানামুখী তৎপরতা। পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জোর প্রচেষ্টায় বৃহস্পতিবার (১২ নভেম্বর) দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে সাত খুনের মামলায় প্রধান অভিযুক্ত আসামী নূর হোসেনকে।
এদিকে আলোচিত এ হত্যাকণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এরই মধ্যে র্যাব-১১-এর সাবেক তিন কর্মকর্তা লে. কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মাদ, মেজর (অব.) আরিফুর রহমান ও লে. কমান্ডার এম এম রানাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তারা তিনজনই এখন কারাগারে রয়েছেন।
ডাণ্ডাবেড়ি পরা সাত খুনের আসামির মুখে তখনও হাসি!
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০১৫
এজেড/