গাইবান্ধা রেল স্টেশন থেকে: ট্রেনের নাম সেভেন আপ। তাও না-কি আবার ডাক নাম।
গাইবান্ধা স্টেশনের মাস্টার বীরেন্দ্র নাথ দাস খানিকটা কৌতুক করে বলেন, মানুষের যেমন একটি ভালো নাম থাকে আরেকটি ডাক নাম থাকে। তেমনি প্রত্যেক ট্রেনের একটি ভালো, একটি ডাক নাম রয়েছে।
সেভেন আপ হচ্ছে ট্রেনটির ডাক নাম। আর এর ভালো নাম হচ্ছে উত্তরবঙ্গ মেইল। তবে উত্তরবঙ্গ মেইল বললে সাধারণ মানুষ চিনবে না। ডাক নাম এমন হওয়ার কারণ হিসেবে বলেন, ট্রেনটির নম্বর হচ্ছে সেভেন। যেহেতু উর্ধমুখী যায় তাই একে সেভেন আপ বলা হয়।
সকাল সাড়ে ৯টায় সান্তাহার স্টেশন থেকে পঞ্চগড়ের উদ্দেশে রওয়ানা করে ট্রেনটি। সন্ধ্যা ৭.৪০ টায় পঞ্চগড় থেকে সান্তাহারের উদ্দেশে ফিরতি যাত্রা শুরু করে। তখন এর নম্বর হয় এইট। তখন একে এইট ডাউন বলে ডাকা হয়। চলার সিডিউলটি কিন্তু তালিকানুযায়ী। কিন্তু সিডিউলে কোনদিনই চলেনি এই ট্রেনটি।
কোমল পানীয় যেমন ভালো-মন্দ বিচার না করেই আমরা অনেকে গিলছি। তেমনি উত্তর জনপদের লোকজন প্রতিদিন বাদুড় ঝোলা হয়ে এই ট্রেনে যাতায়াত করছেন। অন্য ট্রেন মাঝে মধ্যে ফাঁকি দিলেও সেভেন আপ কিন্তু যাত্রীদের ফাঁকি দেয় নি।
তবে সকাল ১০টার ট্রেন কখনও কখনও বিকেল গড়িয়ে দেখা দেয়। তখন সেভেন আপ না-কি কোকাকোলা (অন্যট্রেন) বুঝবার উপায় থাকে না যাত্রীদের কাছে। অনেক সময় জানান দেওয়ার জন্যও স্টেশনে কাউকে পাওয়া যায় না। ট্রেন স্টেশনে এলেই লোকজন পড়িমরি করে উঠে পড়েন।
কিন্তু যখন অন্য যাত্রীদের কাছে জানতে পারেন ভুল ট্রেনে উঠে পড়েছেন, তখন পরের স্টেশনে নেমে ভুল সুধরে নেন। এই ভুল সুধরে নেওয়ার প্রক্রিয়াও খুব সহজ নয়। পরের ট্রেনের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয়।
কতকাল ধরে সেভেন আপ চলছে তার সঠিক ইতিহাস জানাতে পারলেন না স্টেশন মাস্টার। লোকাল এই ট্রেনটির বগিগুলোর অবস্থা অবর্ণনীয়। রঙ চটে গিয়ে মালবাহী বগির মতো শ্রীহীন হয়ে পড়েছে।
ভেতরের অবস্থা আরও ভয়াবহ। ট্রেনের মেঝেটি লোহার না-কি সিমেন্টের প্লাস্টার বুঝবার জো নেই। যেখানে সেখানে ইঁদুরের গর্তের মতো ফুটো হয়ে গেছে। সেই ফুটো দিয়ে রেল লাইনের পাথর উকি দিচ্ছে। আবার ছাদের ফুটো দিয়ে পুর্ণিমার চাঁদ উপভোগ করতে করতে গন্তব্যে পৌঁছান যাত্রীরা।
ট্রেনের ভেতরে বেশিরভাগ লাইটের আলো কমে গেছে। সেগুলো কদাচিৎ আলো দেয়। কেউ কেউ সকৌতুক করে বলেন, কামরার ভেতরে অন্ধকার থাকলে পুর্ণিমার চাঁদ দেখতে সুবিধা হয়।
সেভাবেই বগিগুলোর ডিজাইন করা হয়েছে। রেলওয়ের লোকজন অনেক ভালো বলেই এর জন্য বাড়তি চার্জ নেন না।
কিন্তু অনেক সময় বেরসিক বৃষ্টি পুর্ণিমার চাঁদকে কবিতার সেই ঝলসানো রুটিতে পরিণত করে, আর তখনই যাত্রীরা পড়েন দুর্ভোগে।
মাকড়সার জাল ট্রেনের বগিগুলোর আনাচে কানাচে। বগিগুলোর ভেতরে দেখলে মনে হবে যেনো ময়লাবাহী ট্রেন। অন্যান্য ট্রেনের ময়লা ঝাড়ু দিয়ে এই ট্রেনের বগিতে করে ফেলতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে পীরগাছা স্টেশনের ম্যানেজার আবুল হাসেম বাংলানিউজকে জানান, প্রত্যেকবার ছাড়ার আগেই ট্রেন পরিষ্কার করা হয়। তাহলে মাকড়সার জাল কিভাবে থাকে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কিছু সমস্যা তো আছেই। এটা স্বীকার করতেই হবে।
ট্রেনটিতে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বড়ই চমকপ্রদ। লোকাল ট্রেন না বলে হকার ট্রেন বলে মন্তব্য করেন যাত্রী লিটন মিয়া। যাত্রীর সংখ্যা বেশি না-কি হকার বেশি সে বিষয়ে প্রশ্ন তোলা যায় অনায়াসে।
কি নেই ট্রেনটিতে। দাঁতের মাজন থেকে শুরু করে, মাথা ব্যথা, চুলপড়া বন্ধ, মাথায় নতুন করে চুল গজানো, বাতের ব্যথা, সর্দি কাশি থেকে হুপিং কাশির ওষুধ সবই হাতের নাগালে।
আবার তাবিজ কবজ থেকে ধাতুর আংটি স্বপ্নে সব গাছাড়ি ওষুধ মিলবে হাত বাড়ালেই। খাবারের পসরার নেই কোনো অভাব। সিজেনাল সব ফল থেকে রুটি বিস্কুট, কোমল পানীয়ের ছড়াছড়ি। যার কোনটিরই মেয়াদ কিংবা মান নিয়ন্ত্রণের কোনো সিল দেখা যায় নি।
ট্রেনের গাদাগাদির মধ্যেই ভীড় ঠেলে সবার হাতে পৌঁছে দেওয়ার মহান ব্রত নিয়ে রয়েছেন শত শত হকার। একেকটি কামরার মধ্যে ৪ থেকে ৫ জন করে হকারের দেখা মিলবে যে কোনো সময়।
অনেক সময় ভেতরে থাকা হকারদের বেরিয়ে যাওয়ার জন্য অন্য হকারকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।
ট্রেনটির দাঁড়াবার যেন ঠিক ঠিকানা নেই। কখন কোথায় থামছে, তা স্টেশন হোক আর যাই হোক তাতে আপত্তি নেই তার।
বাংলাদেশ সময়: ০২০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০১৫
এসআই/আরএ
** আমিই ট্রেনের খোঁজ পাচ্ছি না