ময়মনসিংহ: চলছিল জল্পনা-কল্পনা। ছিল অপেক্ষাও।
সাহিত্য, সংস্কৃতি ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার এ প্রাণকেন্দ্রের নতুন নামকরণ করা হয়েছে ‘অ্যাডভোকেট তারেক স্মৃতি অডিটরিয়াম’।
ময়মনসিংহের সাবেক জনপ্রিয় মেয়র প্রয়াত অ্যাডভোকেট মাহমুদ আল নূর তারেকের স্মৃতি জাগ্রত রাখতে তার নামে টাউন হলের নামকরণ করা হয়েছে। শনিবার (১৪ নভেম্বর) বিকেলে এ টাউন হল উদ্বোধন করা হবে।
এর মধ্য দিয়ে সংস্কৃতিকর্মী ও সংগীতপ্রেমীদের এ তীর্থস্থানটি আবারও সরগরম হয়ে উঠবে। প্রাণ ফিরে পাবে নগরীর শিল্প-সাহিত্য চর্চা। স্বপ্নের টাউন হলের নতুন অবয়বে ফিরে আসায় আনন্দিত সংস্কৃতিকর্মী ও সংগঠকরাও।
মুক্তাগাছার জমিদার মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী ১৮৮৪ সালে এ টাউন হল প্রতিষ্ঠা করেন। ময়মনসিংহ শহরের সংগীত ও নাট্যচর্চার উন্মেষ ঘটানোর লক্ষ্যে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ওই সময় এর নির্মাণ ব্যয় ছিল ৩০ হাজার টাকা।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব স্বপন ধর বাংলানিউজকে জানান, ১৯২৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এ টাউন হলে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সংবর্ধিত করে ময়মনসিংহের নাগরিক কমিটি। এরপর আন্তর্জাতিক অনেক প্রথিতযশা ব্যক্তিকে এখানে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সূর্যকান্ত এ টাউন হলে একটি লাইব্রেরিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু সেটি এখন আর নেই।
পরবর্তী সময়ে ১৯৭৪ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম নতুন করে টাউন হলটি সংস্কারের উদ্যোগ নেন। সেই থেকেই এ টাউন হল ময়মনসিংহের সংস্কৃতি ও সংগীত চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।
ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নীরব সাক্ষী এ টাউন হল শুধু সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডই নয়, ছিল রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের চারণভূমি। পাহাড়ী সান্ন্যাল, শিশির ভাদুড়িসহ উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী ও নাট্যকার এ টাউন হলে এসে মঞ্চনাটক করেছেন।
এ টাউন হল থেকেই আনোয়ার হোসেন, আমজাদ হোসেন, আশীষ কুমার লৌহ, লালু মিয়াসহ অনেক প্রথিতযশা শিল্পীর প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্তির সূচনা হয়। ২০০১ সালের প্রথম দিকে ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় টাউন হলটি ভেঙে ফেলা হয়। এরপর কেটে যায় সাতটি বছর।
ময়মনসিংহ পৌরসভার একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ৪ কোটি ৪৪ লাখ ৫৮ হাজার টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় নির্ধারণ করে ২০০৮ সালের জানুয়ারি মাসে ময়মনসিংহ আধুনিক টাউন হলের নির্মাণ কাজের দরপত্র আহ্বান করা হয়। ঢাকার নাজমা কনস্ট্রাকশন নামে একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে নির্মাণ কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
প্রথমে ১ কোটি টাকা বরাদ্দ মেলে। ২০০৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. শামসুল আলম নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন।
পরে অর্থাভাবে কয়েক বছর নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকে। ২০১১ সাল থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রণালয় থেকে বাকি টাকা ছাড় করা হয়। এরপর আবার নির্মাণ কাজ শুরু হয়। সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে চলতি বছর এ অডিটরিয়ামের নির্মাণ কাজ শেষ হয় বলে জানান ময়মনসিংহ পৌরসভার মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা মো. ইকরামুল হক টিটু।
নবনির্মিত ‘অ্যাডভোকেট তারেক স্মৃতি অডিটোরিয়াম’ এখন সুদৃশ্য ভবন। দু’তলা বিশিষ্ট গ্যালারির আসন সংখ্যা সাড়ে ৭শ’। রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ, অত্যাধুনিক লাইটিং ও ইলেকট্রনিক সাউন্ড সিস্টেম। আছে নিজস্ব জেনারেটর ব্যবস্থা।
ইকরামুল হক টিটু বাংলানিউজকে বলেন, শনিবার এ অডিটোরিয়াম উদ্বোধন করা হবে। এর মধ্য দিয়ে সংস্কৃতি কর্মীদের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হতে যাচ্ছে। এ টাউন হলকে এ অঞ্চলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আধুনিক টাউন হল হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। এ উপলক্ষ্যে ৪ দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
টাউন হল উদ্বোধনের মধ্যে দিয়ে ময়মনসিংহের সাংস্কৃতিক চর্চা আরও গতি পাবে বলে মনে করেন সংস্কৃতি কর্মী ও সংগঠকরা। ময়মনসিংহের শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনের মানুষদের মাঝে ফিরে এসেছে ফুরফুরে মেজাজ। তবে তারা টাউন হলের ভাড়া সহনীয় পর্যায়ে রাখার দাবি জানিয়েছেন।
ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদের সাধারণ সম্পাদক ইয়াজদানী কোরায়শী বলেন, এ টাউন হল ছিল আমাদের সব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। যে নামেই হোক টাউন হল ফিরে পাবার সংবাদে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সবাই আনন্দিত। এর মাধ্যমে আবারও ফিরে আসুক সংস্কৃতি চর্চার জোয়ার, এ প্রত্যাশা আমার।
এ বিষয়ে জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের যুগ্ম আহবায়ক, কবি ও নাট্যকার ফরিদ আহমেদ দুলাল বলেন, সংস্কৃতি কর্মীদের এ প্রিয়াঙ্গণের উদ্বোধনের মধ্যে দিয়ে আমাদের প্রাণের দাবি পূরণ হতে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্বও কেটে যাবে। তবে এর ভাড়া যেন সংস্কৃতি কর্মীদের আওতার মধ্যে থাকে, এ দাবি জানাই।
বাংলাদেশ সময়: ০২৫৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০১৫
আরএম