দেওয়ানগঞ্জ থেকে: দেখেন না দোলনার মতো দুলছে। আর ভেতরের লোকজন চাপাচাপি (ঠাসাঠাসি) করে চলাচল করে।
শনিবার (১৪ নভেম্বর) পাবর্তীপুর থেকে সান্তাহার যাওয়ার সময় একজন যাত্রী এভাবেই ব্যঙ্গ করে দোলনচাপা এক্সপ্রেসের নামকরণের নতুন ব্যাখ্যা দিলেন। আর ভিড়ের মধ্যে গাদাগাদি করে থাকা যাত্রীরা ক্ষণিকের জন্য সব দুর্ভোগ ভুলে হো-হো করে হেসে ওঠলেন। কেউ কেউ যোগ করেন- একদম খাটি কথা।
ট্রেনটি ভোর ৫.৪০টায় পার্বতীপুর জংশন থেকে সান্তাহারের উদ্দেশে যাত্রা করে। সান্তাহারে পৌঁছায় ১২.২০টায়। আবার দুপুর দেড়টায় সান্তাহার থেকে দিনাজপুরের উদ্দেশে যাত্রা করে। যা বাংলাদেশ রেলওয়ের হিসেব অনুযায়ী। কিন্তু এই সিডিউলে কোনো দিনই ট্রেনটির দেখা মেলে না।
হেলেনা বেগম নামে এক যাত্রী জানান, আজকে প্রায় পৌনে দুই ঘণ্টা পরে পার্বতীপুর থেকে ছেড়েছে। ট্রেনটি ধরার জন্য ভোররাতে না খেয়েই শিশু কন্যাকে নিয়ে স্টেশনে হাজির হন। তার হিসেব ছিল গন্তব্য গাইবান্ধা ১০টার মধ্যেই পৌঁছে যাবেন। সেখানে গিয়ে সকালের খাবার খাবেন। কিন্তু সকাল ১০টায় তিনি কাউনিয়া পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হন। ১০ বছর বয়সী ছোট্ট মেয়েটি বারবার খাবারের আবদার করছিল। কিন্তু নিচে নেমে খাবার কিনে উঠবেন! তিনি কেন কোনো পুরুষ মানুষের পক্ষেও সম্ভব না।
কারণ যাত্রীরা লাগা লাগা ভাবে দাঁড়িয়ে। কোনো ফাঁক নেই। এতে হকার ওঠার রাস্তাও বন্ধ। এ কারণেই হয়ত দোলনচাপার এই ব্যঙ্গ নামকরণের যথার্থতা খুঁজে পান যাত্রীরা। এতো যাত্রীর চাপ কিন্তু ট্রেনটির বগির কোনো ব্যবস্থা হয় না। মাত্র ৬টি বগি নিয়ে ট্রেনটি চলাচল করে বলে জানালেন পরিচালক রইচ উদ্দিন শিকদার।
ট্রেনটির নামের সঙ্গে এক্সপ্রেস থাকলেও চেহারা সুরতে লোকাল ট্রেনের চেয়েও নিম্ন মানের। কতদিন যে পরিচ্ছন্নকর্মীর হাত পড়েনি তা নষ্ট ফ্যানগুলোর দিকে তাকালেই অনুমিত হয়। মাকড়সা জাল বুনেছে, আর সেই জালে উড়ন্ত ধুল এসে আশ্রয় নিয়েছে।
ছবি তুলতে দেখে একজন সাদা পোশাকধারী এগিয়ে আসেন। জানতে চান কিসের ছবি তোলা হচ্ছে। মাকড়সার জালের কথা বলা হলে পাল্টা প্রশ্ন করেন এই ছবি দিয়ে কী দরকার, আপনার পরিচয়টা কী, আপনি কী করেন...। একগাদা প্রশ্ন করেন খানিকটা উত্তেজিত ভঙ্গিতে।
ছোট্ট করে জবাব দিলাম, আমি একজন যাত্রী। তাহলে ছবি দিয়ে কী করবেন? উত্তর, দেখি কিছু করা যায় কিনা। আবারও পরিচয়ের জন্য প্রশ্ন তার। কিন্তু উত্তর না দিয়ে উল্টো তার নাম-পরিচয় জানতে চাইলে দ্রুত ভিড় ঠেলে সামনে চলে জান।
কিছুক্ষণ করে রইচ উদ্দিন শিকদারের দেখা মেলে। তিনি খানিকটা নরম সুরে বলেন, ভাই কি সাংবাদিক নাকি? হ্যাঁ জবাব পেলে বলেন, ট্রেনটি বছরে দুই ঈদের দিনে মাত্র বন্ধ থাকে। পরিষ্কার করবো ক্যামনে। সামনে গিয়ে দেখেন ট্যাংকি ফুটো হয়ে গেছে বগির ভেতর পড়ছে পানি। অনেকবার বলা হয়েছে কিন্তু কোনো সমাধান হয়নি। অনেকগুলো ফ্যানও নষ্ট।
সম্ভব হলে স্যারদের বলেন, এই ট্রেনটাতে যেন আরও কিছু বগি দেন। তাহলে মানুষের কষ্ট কমে যাবে। টিকেট বিক্রি এমনিতেই অনেক ভালো। তখন আরও ভালো হবে বলে জানান রইচ উদ্দিন শিকদার।
তার কথার সঙ্গে কথা ধরেন ট্রেনের যাত্রী আমিনুর রহমান রুবেল মিয়া। কাউনিয়া থেকে ট্রেনে উঠেছেন যাবেন বগুড়ায়। সেখানে একটি ব্যাংকে চাকরি করেন। বললেন, উত্তরবঙ্গের ট্রেন পুরোপুরি অবহেলিত। যমুনা নদী পার হন দেখেন ট্রেনের সার্ভিস কত ভালো এবং অনেক পরিচ্ছন্ন। মোটামোটি টাইমে চলাচল করে।
বিকেলে যখন দেওয়ানগঞ্জে তিস্তা এক্সপ্রেসে উঠি তখন রুবেল মিয়ার কথা কানে বাজতে থাকে। পুরো ট্রেনটি অনেক ঝকঝকে। ফ্যানগুলোতেও নেই কোনো মাকড়সার জাল। আর ঠিক সিডিউল মোতাবেক ঠিক কাটায় কাটায় তিনটায় হুইসেল দিয়ে যাত্রা শুরু করে। তিস্তাও এক্সপ্রেসম, আর দোলনচাপাও এক্সপ্রেস। শুধু নামের হেরফেরে এতো কমবেশি হলে অভিযোগ উঠবে এটাই স্বাভাবিক।
এ বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রী মজিবুল হক বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, ট্রেন অপরিচ্ছন্ন রাখতে পারবে না। আমি এখনই খোঁজ নিচ্ছি।
বগির সংকট প্রসঙ্গে বলেন, স্থানীয়রা যদি তাদের সমস্যার কথা আমাকে লিখিতভাবে জানায় তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৪২৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১৫
এসআই/আইএ