ঢাকা: কলড্রপ, আসলে বিষয়টি কী? অনেকেই হয়তো না জেনেই কলড্রপ নিয়ে বিরক্তি বোধ করেন। সত্যিকার অর্থে কলড্রপ মোবাইল প্রযুক্তির একটি স্বাভাবিক উপসর্গ।
মোবাইল হলো এক ধরনের বেতার তরঙ্গ নির্ভর সেবা। আর বেতার তরঙ্গের কার্যকারিতার ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক অবস্থা বড় ভূমিকা রাখে। এ প্রযুক্তিতে কলড্রপ তাই স্বাভাবিক।
মোবাইল অপারেটর এবং প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেহেতু মোবাইল টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা বেতার প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়, সেহেতু এ সেবায় বিভিন্ন প্রযুক্তিগত কারণে কলড্রপ হতে পারে।
তাদের মতে, নানা কারণেই কলড্রপ হতে পারে। নেটওয়ার্কের দুর্বলতা, ফাইবার অপটিক কেটে গেলে, হ্যান্ডসেটের সক্ষমতা, এমনকি আবহাওয়ার বিরূপ অবস্থার কারণেও কলড্রপ হয়। মাইক্রোওয়েভ এবং রেডিওওয়েভ তরঙ্গ চলাচলের পথে যেকোনো বাধা কল সংযোগের অন্তরায় হয়ে ওঠে।
এসব কারণে একটি পর্যায় পর্যন্ত কলড্রপের হারকে গ্রহণযোগ্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়।
সাধারণত প্রতি ১০০টি কলে ৩টি ড্রপ হলে আর্ন্তজাতিক মান অনুযায়ী তা গ্রহণযোগ্য। ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন্স ইউনিয়নের (আইটিইউ) মানদণ্ড এটি। বাংলাদেশেও এটি মানদণ্ড হিসাবে ধরা হয়।
কিছুদিন ধরে বাংলাদেশে কলড্রপের বিষয়টি আলোচনায় এলেও সাধারণ গ্রাহকদের মধ্যে এটি নিয়ে একটি ধূম্রজাল তৈরি হয়েছে। তবে আশার কথা, দেশের মোবাইল অপারেটররা আর্ন্তজাতিক মানদণ্ডের চেয়ে অনেক ভালো অবস্থানেই আছে।
বিটিআরসি’র হিসাবে দেশের মোবাইল নেটওয়ার্কে কলড্রপের গড় হার মাত্র ১ শতাংশ। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এটি ৩-৫ শতাংশ।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মোবাইল অপারেটরের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও কলড্রপে ভূমিকা রাখতে পারে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় এ দেশের অবস্থান অনেক ভালো।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে বেশিরভাগ হ্যান্ডসেট মানসম্মত নয়। অপেক্ষাকৃত কম দামের এসব হ্যান্ডসেটে অনেক রকম ফিচার থাকার কারণে অনেকগুলোতেই মোবাইল নেটওয়ার্ক ধরে রাখার সক্ষমতা কম।
এছাড়া মোবাইলে যথেষ্ট চার্জ না থাকলে কলড্রপের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। চার্জ কমে যাওয়ার কারণে সিগন্যাল ধরে রাখতে না পারার সমস্যায় যাতে কলড্রপ না হয় সেটা নিশ্চিত করতে মোবাইলে অন্তত অর্ধেক চার্জ থাকা ভালো।
কলড্রপের পাশাপাশি অনেক সময় গ্রাহকরা নেটওয়ার্ক কনজেশানের শিকার হন। সাধারণত কোনো এলাকায় মাত্রাতিরিক্ত লোক সমাগমের কারণে এটা হয়। এমন অভিজ্ঞতায় কল করার পরে গ্রাহক হয়তো কথা শুনতে পারেন না। ভালো খবর হলো, বাংলাদেশে মোবাইল অপারেটরদের নেটওয়ার্কের পরিমাণ শূন্য দশমিক ৭ ভাগেরও কম।
মোবাইল অপারেটররা বলছেন, সবচেয়ে বড় সমস্যা শহর এলাকায়। প্রায় প্রতিদিনই নতুন ইমারত নির্মাণের কারণে মোবাইলের বিটিএস ঢাকা পড়ছে। এসব বিটিএস পুনরায় ভালো এবং খোলা জায়গায় প্রতিস্থাপনের আগ পর্যন্ত সে এলাকার মানুষ কলড্রপ পেতে পারেন। ঢাকার মতো দ্রুত বর্ধনশীল শহরে বিটিএস আশপাশের সব ভবনের চেয়ে উঁচুতে রাখাও একটি অব্যাহত চ্যালেঞ্জ।
আর একটি বড় বিষয় হচ্ছে থ্রি-জি প্রযুক্তির বিস্তার। প্রায় সকল অপারেটরই এখন থ্রি-জি প্রযুক্তির নেটওয়ার্কের বিস্তার ঘটাচ্ছে। প্রথম পর্যায়ে সবাই বিটিএস টু বিটিএস থ্রি-জি প্রযুক্তি সেবা নিয়ে যাবেন। সমগ্র দেশে এটি শেষ হতে আরও বেশ কিছুদিন সময় লাগবে।
এর পরবর্তী ধাপে আসবে নেটওয়ার্ক কার্পেটিং। কিছু অপারেটের অবশ্য ইতোমধ্যে শুরু করেছে। কার্পেটিংয়ের অর্থ, বিটিএস টু বিটিএস থ্রি-জি সেবা চালু করার পর কিছু কিছু জায়গায় পরিপূর্ণ নেটওয়ার্ক নাও পাওয়া যেতে পারে। যেমন বিল্ডিংয়ের ভেতর ও হাইওয়েতে এটা ঘটে। এসব জায়গায় পরিপূর্ণ নেটওয়ার্ক নিশ্চিত করার জন্য ছোট ছোট কিছু উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিটিএস বসানো হয়। এ পর্যায়টি হলো কার্পেটিং।
বাংলাদেশে টু-জি প্রযুক্তির বিস্তার সম্পন্ন হতে প্রায় ১৫ বছর লেগেছে। তবে পরিপূর্ণ থ্রি-জি সেবার জন্য খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। আগামী বছরের মধ্যেই এ সেবার নেটওয়ার্ক পরিপূর্ণভাবে বিস্তার লাভ করবে বলে অপারেটররা জানিয়েছে।
মনে রাখতে হবে, একটি মোবাইল থেকে উৎসায়িত কলের সংকেত টাওয়ারে আসার পর সেটি ফাইবার ট্রান্সমিশন লাইনের মাধ্যমে কিংবা মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গের মাধ্যমে বিভিন্ন সুইচিং সেন্টারে পৌঁছে সংযোগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। এরপর আবারও ফাইবার ট্রান্সমিশন বা মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গের মাধ্যমে আরেকটি মোবাইলে পৌঁছে দিয়ে কল সংযোগ সম্পন্ন করা হয়। এক্ষেত্রে ফাইবার ট্রান্সমিশন লাইন বেশি নির্ভরযোগ্য হলেও মোবাইল সেবাদানের এ অপরিহার্য অংশটুকুর কার্যক্রম বাংলাদেশে মোবাইল অপারেটরদের ব্যবসায়িক আওতার বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
অপরদিকে যেসব সংস্থা এ সেবায় নিয়োজিত তাদের ফাইবার ট্রান্সমিশন লাইনের সরবরাহ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল হওয়ায় এক মোবাইল থেকে আরেক মোবাইলে কল সংযোগ প্রতিষ্ঠার জন্যে মোবাইল অপারেটরদের অনেকটাই মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গের ওপর নির্ভর করতে হয়।
বাংলাদেশে এক মোবাইল থেকে আরেক মোবাইলে সংযোগ স্থাপনের প্রক্রিয়াটি অন্য আর কোনো দেশের মতো নয়। এখানে একই অপারেটরের এক মোবাইল থেকে আরেক মোবাইলে (অন নেট) কল পাঠাতে এনটিটিএন দিয়ে কল যায়। আরেক অপারেটরের মোবাইলে কল পাঠাতে (অফ নেট) আইসিএক্স দিয়ে যায় আর আন্তর্জাতিক কল স্থাপিত হয় আইজিডব্লিউ দিয়ে।
দেশের সবচেয়ে বড় অপারেটর গ্রামীণফোনের হেড অব কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স মাহমুদ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, টেলিযোগাযোগে কলড্রপ কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়। তিনি দাবি করেন, থ্রি-জি সেবায় তাদের কলড্রপের হার শূন্য দশমিক ২ শতাংশেরও কম।
তিনি আরও বলেন, নেটওয়ার্ক বিস্তারে গ্রামীণফোন সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এখানে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, গ্রামীণফোনের লক্ষ্য সবচেয়ে ভালো ইন্টারনেট সেবা দেওয়া এবং সবার জন্য মানস্মত ইন্টারনেট নিশ্চিত করা। যে কারণে গ্রামীণফোন থ্রি-জি নেটওয়ার্ককে অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের মতো মূল্য সচেতন বাজারে অত্যন্ত সুলভ সেবা দেওয়ার পরও মোবাইল অপারেটরগুলো সেবার মান বজায় রাখতে যথেষ্ট যত্নশীল। বাজার পরিণত হলে এবং হ্যান্ডসেটের মান নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষ কঠোর হলে পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে।
রবি’র ভাইস প্রেসিডেন্ট (কমিউনিকেশনস অ্যান্ড কর্পোরেট রেসপনসিবিলিটি) ইকরাম কবীর বলেন, মোবাইল টেলিযোগাযোগের প্রযুক্তিটি যেহেতু তারবিহীন, সুতরাং একটি গ্রহণযোগ্য মাত্রায় কলড্রপের ঘটনা ঘটতে পারে। এ ব্যাপারে আমরা বিটিআরসি’র দেওয়া একটি নির্দেশনা অনুসরণ এবং প্রতি মাসে সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রদান করছি।
রবি’র কলড্রপের মাত্রা খুবই কম এবং এটি বৈশ্বিক ও স্থানীয় পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের কলড্রপের হার ১ শতাংশের কম, যা বিটিআরসি’র বেঁধে দেওয়া সীমা ৩ শতাংশের চেয়ে অনেক কম।
ইকরাম কবীর বলেন, এরপরও সম্মানিত গ্রাহকদের আরও মানসম্মত সেবা প্রদানের লক্ষ্যে আমরা প্রতিনিয়ত বিনিয়োগ করে যাচ্ছি। ২০১৪ সালে ২৬৭ মিলিয়ন এবং ২০১৫ সালের প্রথমার্ধে ১৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে রবি।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৩০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১৫
এমআইএইচ/এএসআর