ঢাকা: ১২ বছরে পদার্পণ করলো দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০০৪ সালের ২১ নভেম্বর দুর্নীতি দমন ব্যুরো থেকে কমিশনে রুপান্তর হয় সংস্থাটি।
ব্যুরো থেকে কমিশনে রূপান্তরের পর নানা আলোচনা আর সমালোচনায় ছিল দুদক। ওয়ান ইলেভেনে প্রধান দু’দলসহ দেশের বড় ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতার করে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনায় চলে আসে রাষ্ট্রীয় এ দুর্নীতি দমন সংস্থাটি।
ওয়ান ইলেভেনের পর টানা দু’তিন বছর নিষ্ক্রিয় থেকে বড় কলরবে কয়েকটি দুর্নীতির ঘটনায় দুর্নীতিবাজদের শাস্তির আওতায় এনে কিছুটা প্রশংসা পায় দুদক। অন্যদিকে বিভিন্ন অভিযোগ থেকে প্রভাবশালীদের দায়মুক্তি দিয়ে বিতর্কের মুখেও পড়তে হয়েছে সংস্থাটিকে। এতে দুদকের প্রতি বেড়েছে জন অনাস্থাও।
বর্তমান কমিশন মনে করছে, তাদের আমলেই দুদক সবচেয়ে বেশি সফলতা দেখাতে পেরেছে। দুদক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, ‘সমালোচনার জায়গা হয়তো আছে। তবে বর্তমান কমিশনের সফলতা অনেক। অনেক কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে পেরেছে দুদক। ’
দুদক চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘আমরা দল না দেখে ব্যক্তির অপরাধ দেখে ব্যবস্থা নিয়েছি, নিচ্ছি। কে সরকারি দল আর কে বিরোধী দল এটা আমাদের কাছে বড় নয়। ’
তবে দুদকের প্রধান এ কর্তার কথা মানতে নারাজ দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দলসহ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
বিএনপি চেয়ারপার+সন খালেদা জিয়া একাধিকবার দুদকের সমালোচনায় বলেছেন, ‘এটা দায়মুক্তি কমিশন। নিজেদের লোকদের দায়মুক্তির সার্টিফিকেট দেওয়া আর প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে ঘায়েল করাই দুদকের কাজ। ’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সময়ে কড়া সমালোচনা করা হয়েছে। দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বার্লিন ভিত্তিক দুর্নীতি বিরোধী এ প্রতিষ্ঠানটিও।
বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা আসলেও দুদকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা নিজেদের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন, জনপ্রশাসনের তিন সচিবসহ চারজনের যে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করা হয়েছে, তার কৃতিত্ব দুদকেরই। এছাড়া হলমার্ক, ডেসটিনি, বিছমিল্লাহ গ্রুপের দুর্নীতি ও এমএলএম কোম্পানির প্রতারণার মামলা দুদকের বড় সাফল্য। হলমার্ক ও ডেসটিনির শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের দুদকের মামলায় কারাবরণ করতে হয়েছে। পদ্মাসেতু দুর্নীতির ষড়যন্ত্র মামলায় সাবেক সেতু সচিব মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়াকেও গ্রেফতার করে জেলে পাঠাতে পেরেছে দুদক।
বর্তমান সরকারের একজন সংসদ সদস্যকেও (কক্সবাজারের আবদুর রহমান বদি) দুর্নীতির মামলায় কারাগারে যেতে হয়েছে।
মহাজোট সরকারের সাবেক মন্ত্রী এবং বর্তমান এমপির বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের অভিযোগে মামলা দায়েরও সফলতা মনে করছে দুদক।
এছাড়া গত বছর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর বিদেশে পাচার করা প্রায় সাড়ে ২১ কোটি টাকা ফেরত আনাকে নিজেদের সফলতা মনে করছে বর্তমান কমিশন।
দুদকের কাছে এগুলো অর্জন মনে হলেও আলোচিত কয়েকটি ঘটনায় অভিযুক্তদের অব্যাহতি দেওয়ায় সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হতে হয়েছে সংস্থাটিকে।
ব্যাংকি সেক্টরে বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে রাঘব-বোয়ালদের মামলা থেকে বাদ দেওয়ায় দুদকের অনুসন্ধান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন মহলে। চলতি বছর কর্ণফুলী গ্যাসফিল্ড কোম্পানি লিমিটেডে জনবল নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের মামলা থেকে প্রধান অভিযুক্ত পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান ড. হোসেন মনসুরকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া দুদক থেকে গত তিনবছরের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি দায়মুক্তি পেয়েছেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পের দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ থেকে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীসহ দুদকের মামলার এজাহারভুক্ত আসামি সাবেক সেতু সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, সেতু বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (নদী শাসন) কাজী ফেরদাউস, সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী (ব্রিজ কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স ডিভিশন) রিয়াজ আহমেদ প্রমুখকে দায়মুক্তি দেওয়ায়ও নানা মহল থেকে সমালোচনা হয়েছে। বিভিন্ন পক্ষ থেকে সমালোচনা এলেও দুদকের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা দালিলীক তথ্যের প্রমাণ না পেলে কারো বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেন না।
এ ছাড়াও নবম সংসদে নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা হলফনামায় অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধি পাওয়া সংক্রান্ত অভিযোগ থেকে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক, সাংসদ আসলামুল হককে দায়মুক্তি দেয়ায় সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হতে হয়েছে দুদককে।
এর আগে ২০১৩ সালে ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও সাবেক সাংসদ এইচবিএম ইকবালকে অবৈধ সম্পদ অর্জনের দুটি অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দেয় কমিশন। ২০০১ সালে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে আদমশুমারি প্রকল্পে ৯৪ কোটি টাকা অপব্যবহারের অভিযোগে মহীউদ্দীন খান আলমগীরের বিরুদ্ধে দুদক অনুসন্ধান শুরু করে ২০০৭ সালে। ২০১৩ সালে এ অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি পান তিনি।
১৯৫৭ সালে অ্যান্টি করাপশন অ্যাক্ট প্রণয়ন করা হয় এবং এর আওতায় দুর্নীতি দমন ব্যুরো গঠিত হয়। ২০০৪ সালের ২১ নভেম্বর দুর্নীতি দমন ব্যুরো বিলুপ্ত হয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) রুপান্তরিত হয়।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর নানা আয়োজন
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একাদশতম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ২১ নভেম্বর। কিন্তু দিনটি সরকারি ছুটির দিন হওয়ায় পরদিন ২২ নভেম্বর রোববার দিবসটি উদযাপন করবে দুদক।
দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ ও গবেষণা) ড. মো. শামসুল আরেফিন বলেন, ২২ নভেম্বর সকাল সাড়ে নয়টায় কমিশনের প্রধান কার্যালয় প্রাঙ্গণ এবং বিভাগীয় ও সমন্বিত জেলা কার্যালয় প্রাঙ্গণে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে জাতীয় পতাকা ও দুর্নীতি দমন কমিশনের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কার্যক্রম উদ্বোধন করা হবে।
এরপর কমিশনের প্রধান কার্যালয় প্রাঙ্গণে দুদক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান কেক কাটবেন। সকাল ১০টায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা অডিটরিয়াম এবং বিভাগীয় ও সমন্বিত জেলা কার্যালয় প্রাঙ্গণে কর্মকর্তা/কর্মচারীদের শপথ বাক্য পাঠ করাবেন দুদক চেয়ারম্যান। দুপুর পর্যন্ত শিল্পকলার অডিটরিয়াম ও বিভিন্ন জেলা কার্যালয়ে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। ঢাকায় এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৩১৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২১, ২০১৫
এডিএ/জেডএস