বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী বলেছেন, সংস্কৃতি একটি সমাজের প্রাণ। এটি মানুষের জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলে।
শনিবার (২০ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে টেলিভিশন রিপোর্টাস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ট্র্যাব আয়োজিত সাংস্কৃতিক সংকট: উত্তরণের উপায় শীর্ষক আলোচনা সভায় ও ট্র্যাব এক্সিলেন্ট অ্যাওয়ার্ড-২০২৫ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব বলেন।
কাদের গনি চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের সংস্কৃতির গৌরবময় ঐতিহ্য রয়েছে। বাংলার সংস্কৃতিই আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয় আমরা বাংলাদেশি। বাংলাদেশের সংস্কৃতির ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। সুজলা-সুফলা, শস্য শ্যামলা বাংলায় বিচিত্র মানুষ বিচিত্রভাবে বসবাস করে এটাও এ দেশের সংস্কৃতি। এখানে বাস করে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খিস্ট্রানসহ আরও অনেক জাতি। এখানে প্রাণ খুলে তারা তাদের প্রাণের ভাষায় ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান পালন করে। একের অনুষ্ঠানে অন্যরা আমন্ত্রিত হয়ে, আনন্দ ভাগাভাগি করে।
তিনি বলেন, আমাদের সংস্কৃতি সব ধর্মের মতের মানুষকে এক কাতারে দাঁড় করিয়েছে। তাইতো সব ভেদাভেদ ভুলে ভাষার জন্য আন্দোলন করে আমরা জয়ী হয়েছি। ৭১'র মুক্তিযুদ্ধে আমরা বিজয় অর্জন করেছি। মনে হয় কবি এজন্যই বলেছেন, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি। ’ আগে পাড়া-মহল্লায় কিংবা বটতলায় দেশীয় বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বসত বাউলাদের মন মাতানো আসর। নদীমাতৃক বাংলার পূর্ববঙ্গে ভাটিয়ালি, উত্তরবঙ্গে ভাওয়াইয়া, পশ্চিমবঙ্গ কীর্তন ও বাউল জারিসারি, পল্লীগীতির আসর বসতো, আর এসব গানের মধ্যে দিয়ে উপলব্ধি করা যেত মা, মাটি ও মানুষের গন্ধ। মাজারগুলোকে কেন্দ্র করে আধ্যাত্মিক গানের আসর বসতো। মাইজভাণ্ডারী গান, লালন সঙ্গীত, শাহজালালের গান আমাদের সংস্কৃতিকে অনেক সমৃদ্ধ করেছে। এখন এসব বাউল ও ভাণ্ডারী গানের শিল্পীদের পাওয়া দুষ্কর। এখন বাউল গানের জায়গা স্থান করে নিয়েছে বিদেশি হেভি মেটাল গান। যে গানের আছে শেখার কিছু, না আছে নাড়ির টান। এখন পাড়া-মহল্লায় সাউন্ড বক্সে বিদেশি গান ছাড়া কোনো আয়োজন বৃথা মনে হয়। অথচ আমাদের আছে বিশ্বমানের আব্বাস উদ্দিন, আবদুল আলিম কিংবা লালন ফকির, শাহ আবদুল করিম, রমেশ শীলের গান। যাত্রাপালা, বায়োস্কোপ, পুতুল নাচ, কিংবা গানের আসর মনের খোরাক যোগাতো।
আজ বলতে আমার দ্বিধা নেই, স্বাধীনতার পরবর্তীকালে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যে অবস্থা তার ওপর দাঁড়িয়ে সংস্কৃতিও বদলেছে। সেই লোকনৃত্য, জারিসারি, ভাওয়াইয়া, পালাগানের জায়গা দখল করেছে পশ্চিমা তথা ভারতীয় সংস্কৃতিচর্চা।
সাংবাদিকদের এ নেতা বলেন, সংস্কৃতি রক্ষায় অসম্প্রদায়িক চেতনায় দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু বর্তমান দুষ্টু রাজনীতি, ক্ষমতার রাজনীতি, আপসকামীতা রাজনীতি, ধর্মান্ধ রাজনীতি আমাদের গর্বিত সংস্কৃতিকে ধ্বংস করছে। মানুষে মানুষের ভেদাভেদ তৈরি করেছে হিন্দু, মুসলমানে বিভাজন তৈরি করছে। ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করছে। ধর্মীয় উগ্রবাদকে ছড়িয়ে দিয়ে আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধ্বংস করছে। একে অপরকে ঘৃণা করতে শেখাচ্ছে। মাজারে হামলা হচ্ছে, মন্দির ভাঙা হচ্ছে। ভিন্নমতের লোকদের কবর থেকে লাশ তুলে লাশ পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, পহেলা বৈশাখ উদযাপনের জন্য এখন সময় বেঁধে দেওয়া হয়। যাত্রাপালা আর কবিগানের জন্য নিতে হয় অনুমতি।
মাজার আমার সংস্কৃতির অংশ। মাজার কেবল অধ্যাত্মিক আশ্রয় নয়, বরং হয়ে উঠেছে লোকজ সংস্কৃতির উজ্জল প্রতীক হিসেবে। সে মাজার ভাঙার যেন উৎসব চলছে। মাজার সম্পর্কে বলতে গিয়ে ড. মুহম্মদ এনামুল হক ওলি-আউলিয়াদের শক্তি সম্পর্কে লিখেছেন ধর্মান্ধ ও গোড়া বিজেতৃগনের আপ্রাণ চেষ্টা যেখানে নিতান্তই ব্যর্থ ও নিস্ফল বলে প্রমাণিত হইয়াছে। মুসলিম সাধকের উদার ও শান্ত প্রবর্তনা যেখানে আশ্চর্যরূপে সাফল্যমন্ডি হয়েছে। সকল স্তর ও সকল সম্প্রদায়ের সহিত অবাধ মিলনের দ্বারা বিজেতা ও বিজিতের মধ্যে এ মুসলিম সাধকরাই যোগসূত্রের সৃষ্টি করিয়া ছিলেন।
পহেলা বৈশাখ আমাদের লোকায়ত উৎসব। করপোরেট আর এজেন্সিগুলো এখন বর্ষবরণ উৎসব দখল করেছে। এমন কি নৌকাবাইচ এটিও এখন কর্পোরেটের ইভেন্ট। আগে আমরা স্কুল ডিবেট বা বিতর্ক করতাম ব্লাক বোর্ডের ‘শহরের চেয়ে গ্রামভালো’ নিয়ে লিখে দুটো দল বানিয়ে মাতাতাম। এখন একটা বিতর্কের আয়োজন করতে লাখ টাকা খরচ হয়। এভাবে একে একে আমাদের সব উৎসব তারা দখল করছে। আসলে আমাদের সংস্কৃতি এখন ক্ষমতাবানদের হাতে চলে গেছে। ফলে প্রাণের যোগ কমে যাচ্ছে, এখন যা হচ্ছে শুধু আনুষ্ঠানিকতা।
‘আমাদের জীবন থেকে সংস্কৃতি আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে সাংবাদিক নেতা কাদের গনি বলেন, আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন গ্রামে গেলে যাত্রাপালা ও নাটক করতাম এবং দেখতাম। মেলা বসত। আমরা সবাই কত হৈচৈ করতাম। আমাদের সংস্কৃতিটা গ্রামে-গঞ্জে আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আমাদের জীবন থেকে অনেক সৌন্দর্য আমরা হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের ছেলে-মেয়েরা এখন আর পাঠাগারে বই পড়তে যায় না। আমাদের ছেলে-মেয়েরা এখন আর গান শোনে না। আমাদের ছেলে-মেয়েরা রবীন্দ্রনাথ-নজরুল পড়ে না। কিন্তু পড়াটা এবং শোনাটা নিজের জীবনকে সুন্দর করার জন্য খুবই জরুরি। শুধু বেঁচে থাকার জন্য তো-বেঁচে থেকে লাভ নেই। জীবনটিকে সুন্দর করে বেঁচে থাকাটাই হচ্ছে আনন্দময় জীবন।
গান এমন একটি শক্তি, যে শক্তিটি আপনার মনের জায়গাটিকে আলোকিত করে দেবে। গানের এমন একটি শক্তি আছে, যে শক্তি দিয়ে আপনার ভোরবেলাটিকে সুন্দর করে দেবে। আপনার জীবনটিকে সুন্দর করে দেবে। আপনার বিষণ্নতাকে কাটিয়ে দেবে। আপনার অন্ধকার জীবনটিকে আলোকিত করে দেবে।
তিনি বলেন, ‘কোচিং ও স্কুল নিয়ে এখন সবাই ব্যস্ত। সংস্কৃতি হয়ে গেছে অপশনাল, ওইটা হয়ে গেছে মূল পাঠ। সবাই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়। কেউ শিল্পী হতে চায় না। সবাই বড় বড় প্রতিষ্ঠানের কথা চিন্তা করে। কেউ সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কথা চিন্তা করে না।
ট্র্যাব সভাপতি কাদের মনসুরের সভাপতিত্বে আলোচনায় আরও বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক এরফানুল হক নাহিদ, চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, চিত্র নাট্যকার ছটকু আহমেদ, এটিএন বাংলার উপদেষ্টা তাশিক আহমদ, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতির (বাচসাস) সভাপতি কামরুল হাসান দর্পণ, ট্র্যাব সাধারণ সম্পাদক সুহৃদ জাহাঙ্গীর, অভিনেতা মোশাররফ হোসেন, অভিনেত্রী ফারজানা ছবি, সঙ্গীত শিল্পী নাদিয়া ডোরা, সুমন, শারমিন আহমেদ মিন্নী প্রমুখ।
আরআইএস