ঢাকা: আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনে সরকারি সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের প্রচারণার সুযোগ রাখা হয়নি নির্বাচনি আচরণ বিধিমালায়। ইতিমধ্যে বিভিন্ন দল এ বিধি পরিবর্তনের দাবি তুলেছে।
পৌরসভা নির্বাচনের আচরণ বিধিমালায় সরকারি সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সজ্ঞায়-প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, মন্ত্রী, চিফ হুইপ, বিরোধীদলীয় নেতা, সংসদ উপনেতা, প্রতিমন্ত্রী, হুইপ, উপমন্ত্রী বা তাদের সমমর্যাদার কোনো ব্যক্তি, সংসদ সদস্য এবং সিটি করপোরেশনের মেয়রকে বুঝিয়েছে ইসি। এসব সুবিধাভোগীরা নির্বাচনটির প্রচারণায় যেতে পারবেন না। সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটার হলে শুধু ভোট দিতে পারবেন।
এ বিধানটির জন্য অন্য দলগুলোর মতো সরকারি দলের সংসদ সদস্যরাও ইসির প্রতি বিরাগভাজন হয়েছেন। গণমাধ্যমে এরই মধ্যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে-আওয়ামী লীগ থেকে এমপিদের প্রচারণার সুযোগ দিতে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেওয়া হবে। শিগগিরই সে চিঠি দেওয়ার কথা রয়েছে।
এছাড়া ওয়াকার্স পার্টি এবং বিএনপিও নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা এবং আচরণ বিধিমালা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ভোটগ্রহণ পেছানোর দাবি তুলেছে।
ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, এ অবস্থায় ব্যাপক অসুবিধায় পড়েছে নির্বাচন কমিশন। কেননা, তফসিল ঘোষণার পর বিধিমালা পরিবর্তন প্রথা বিরোধী। এছাড়া প্রচারণায় সুবিধাভোগীদের সুযোগ রেখেই খসড়া বিধিমালা আইন-মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছিলো ইসি। কিন্তু আইন মন্ত্রণালয়ই সে বিষয়টি বাদ দেওয়ার পক্ষ নিয়েছিলো।
পরবর্তীতে দ্বিতীয় দফায় সুবিধাভোগীদের সুবিধা বাদ রেখে খসড়া বিধিমালা চূড়ান্ত করতে পাঠালে মন্ত্রণালয় তা অনুমোদন দেয় গত ২২ নভেম্বর সোমবার। ২৩ নভেম্বর রাতেই বিজি প্রেস থেকে বিধিমালার গেজেট ছাপায় ইসি। পরদিন ২৪ নভেম্বর মঙ্গলবার, দেশের ২৩৬ পৌরসভায় ৩০ ডিসেম্বর ভোটগ্রহণের তফসিল ঘোষণা করে সংস্থাটি। এরপরই দলগুলোর ভেতর প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এ অবস্থায় ইতিহাসের সবচেয়ে বেকায়দায় নির্বাচন কমিশন।
এ বিষয়ে ইসি সচিব সিরাজুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, নির্বাচন পেছানোর কোনো সুযোগ নেই। নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা বা আচরণ বিধিমালা পরিবর্তনেরও সুযোগ নেই।
শুনেছি এমপিরা ইসির সঙ্গে দেখা করবেন। যদি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করেন, তবে তো আলোচনায় বসতেই হবে কমিশনকে-যোগ করেন সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, যা কিছু হোক বা না হোক, রোববারের আগে কিছু বলা যাচ্ছে না।
নির্বাচন বিধিমালা নিয়ে যত বিস্ময়:
পৌরসভা নির্বাচনের বিধিমালা নিয়ে যত লুকোচুরি, রাখঢাক আর তোড়জোর হয়েছে, ইতিহাসের আর কোনো সময় এমনটি হয়নি বলে মন্তব্য ইসির অনেক কর্মকর্তার।
ইসির কাছে যখন দলীয়ভাবে পৌর নির্বাচনের কোনো চিঠিই সরকারের তরফ থেকে আসেনি, তারও আগে থেকে তারা বিধিমালা সংশোধন নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। একথা সিইসি বারবার গণমাধ্যমেও বলেছেন।
গত ১২ অক্টোবর মন্ত্রীসভায় দলীয়ভাবে স্থানীয় নির্বাচন করার বিষয়টি অনুমোদন হলে, বিধিমালা সংশোধনের কাজে ইসি অনেকটা আদাজল খেয়েই লেগে যায়। পৌরসভা আইনের সংশোধনীর অধ্যাদেশ হয় গত ২ নভেম্বর। এর পরদিন ৩ নভেম্বর তা সংগ্রহ করে ইসি। ওইদিন প্রথমে প্রচারণায় সুবিধাভোগীদের প্রচারণার সুযোগ না রেখেই খসড়া বিধিমালা চূড়ান্ত করা হয়।
পরের দিন ৪ নভেম্বর সকালে এসেই আগের রাতের সিদ্ধান্ত বাতিল করে সুবিধাভোগীদের প্রচারণার সুযোগ রেখে তা অনুমোদনের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায় কমিশন। এ নিয়ে ইসি কর্মকর্তারা দ্বি-মত পোষণ করেন।
তাদের মতে, সুবিধভোগীরা কোনো সুযোগ না নিলেও তারা প্রভাবশালীই থাকেন। তাই নির্বাচনি প্রচারণায় তাদের সুযোগ না দেওয়াই উচিত। সে সময় নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালাতে, প্রাথমিকভাবে একাধিক প্রার্থী মনোনয়নের সুযোগটিও রাখা হয়েছিলো। এখন তা নেই।
গত ৮ নভেম্বর নির্বাচন কমিশনার মো. শাহ নেওয়াজ এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, এমপি-মন্ত্রীসহ সুবিধাভোগীদের প্রচারণার সুযোগ বেখেয়ালে দেওয়া হয়েছে। তারা বিষয়টি লিপিবদ্ধ করার সময় খেয়াল করেননি।
এরই মধ্যে পৌরসভার আইন সংশোধনের অধ্যাদেশ রহিত করে সংসদে আইনের জন্য বিল পাশ হয়। এরপর তা রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরে আইনে পরিণত হয় ১৯ নভেম্বর। দলীয়ভাবে পৌরসভা নির্বাচনের ওই সংশোধিত আইনের গেজেট প্রকাশ হয় ২১ নভেম্বর, যেখানে কেবল মেয়র পদে দলীয় প্রতীকে ভোটগ্রহণের বিধান রাখা হয়। নির্বাচন কমিশন ২২ নভেম্বর সে আইনের গেজেট সংগ্রহ করে।
একদিনের মধ্যেই অর্থাৎ ২৩ নভেম্বর আগে বিধিগুলো পরিবর্তন করে দ্বিতীয় দফায় আইনমন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠায়। মন্ত্রণালয়ে লোক পাঠিয়ে ওইদিন রাত আটটার দিকে অনুমোদন এনে সাড়ে আটটার দিকে সংশোধিত বিধিমালার গেজেট ছাপাতে বিজি প্রেসে লোক পাঠায় ইসি।
এতে সুবিধাভোগীদের প্রচারণা সুযোগ তুলে দেওয়া হয়। একইসঙ্গে প্রাথমিকভাবে একাধিক প্রার্থী মনোনয়নের বিধানটি তুলে দিয়ে প্রথম থেকেই চূড়ান্তভাবে একজন প্রার্থীকে মনোনয়নের জন্য বিধান করা হয়। যে দু’টি বিধান নিয়ে সরকারি দলসহ অন্য দলগুলো আপত্তি তুলেছে।
এদিকে বিধিমালা হওয়ার পর তফসিল ঘোষণা হয়ে গেলেও একজন নির্বাচন কমিশনার জানতেন না, দলগুলো প্রার্থী মনোনয়ন কিভাবে দেবে।
নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) জাবেদ আলী বৃহস্পতিবার (২৬ নভেম্বর) সাংবাদিকদের তার কার্যালয়ে বলেন, প্রথমে দলগুলো একাধিক প্রার্থীর মনোনয়ন দেবে। তারপর বাছাই শেষে প্রত্যাহারের দিন একজন প্রার্থীর নাম চূড়ান্তভাবে জানাবে। সংশ্লিষ্ট দলের অবশিষ্ট প্রার্থীদের মনোনয়ন বাতিল বলে গণ্য হবে। অথচ এ বিধানটি আর রাখা হয়নি। বর্তমানে প্রথম থেকেই একটি দল মেয়র পদে কোনো পৌরসভায় কেবল একজন প্রার্থীকেই মনোনয়ন দিতে পারবে।
এ বিষয়টি সাংবাদিকরা তাকে জানালে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে ইসি কর্মকর্তাদের ফোন করে বিধিমালার গেজেটটি সরবরাহ করার জন্য বলেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা বলছেন, দলগুলোর মতামত আগে নেওয়া হলে, এ বিপাকে পড়তে হতো না। তফসিল ঘোষণার পর এখন যদি বিধিমালা আবার সংশোধন করতে হয়, তবে তা হবে প্রথা বিরোধী কাজ।
তবে গত ৪ নভেম্বর দলগুলোর মতামত নেওয়ার জন্য খসড়া বিধিমালা ৪০টি দলের কাছেই পাঠানোর সিদ্ধান্তও নেন সিইসি। সেদিন ইসির যুগ্ম সচিব জেসমিন টুলী বাংলানিউজকে বলেছিলেন, আমরা দলগুলোর মতামত নেওয়ার জন্য খসড়া বিধিমালা জুড়ে দিয়ে একটি চিঠি পাঠাচ্ছি। এতে তারা মতামত দিলে তা আমলে নিয়ে বিধিমালায় আরো সংশোধন আনা হবে। এমনকি দলগুলোকে খসড়া বিধিমালাসহ চিঠি পাঠানোর জন্য ৪০টি ফোল্ডারও প্রস্তুত করেছিলো ইসির নির্বাচন সহায়তা শাখা। কিন্তু হঠাৎ করেই সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে কমিশন। বিষয়টি নিয়ে ইসি কর্মকর্তারাও বিরুপ সমালোচনা করেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৫১৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৮, ২০১৫
ইইউডি/আরএ