ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

চট্টলা এক্সপ্রেস থেকে মাহবুব আলম

মালগাড়িতে যাত্রী সেবা!

মাহবুব আলম, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৫
মালগাড়িতে যাত্রী সেবা! ছবি: শাকিল/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টলা এক্সপ্রেস থেকে: বাবুল মিয়া; চাচার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে ভোরে চট্টগ্রামের গ্রামের বাড়িতে যেতে কমলাপুর রেলস্টেশনে আসেন।
 
তবে বৃহস্পতিবার (১৭ ডিসেম্বর) সকালের চট্টগ্রামগামী মহানগর প্রভাতী ধরতে পারেননি তিনি।

স্টেশনে পৌঁছাতে পৌঁছাতেই ৭টা ৪০মিনিটে ছেড়ে যায় ট্রেনটি। যানজটের ভয়ে বাসে যাওয়ার সায় পাচ্ছেন না মন থেকে।

উপায়ান্তর না দেখে স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে চট্টলা এক্সপ্রেস ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছেন আর টিকিট খুঁজছেন। কিন্তু হন্যে হয়ে খুঁজেও কাঙ্ক্ষিত টিকিট পাননি তিনি।  

কীভাবে যাবেন বাড়িতে? এদিকে চাচার জানাজা বিকেল ৪টায়। সময় মতো না পৌঁছাতে পারলে তো শেষ দেখাটাও দেখতে পারবেন না চাচাকে। তাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন বাবুল মিয়া।

কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় নেভি-ব্লু কোর্ট পড়া এক পঞ্চাশোর্ধ্ব রেলকর্মী থামালেন তাকে। টিকিটের কথা শোনার পর বললেন, ‘চিন্তা কইরেন না। যাওয়া যাবে। তবে জনপ্রতি দুইশ’ টাকা ভাড়া লাগবে। বইসা বইসা যাইতে পারবেন। ’

বাধ্য হয়ে রাজি হলেন বাবুল। তাকে ৭ নম্বর প্লাটফর্মে বসার কথা বলে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন নিজেকে জয়নাল আবেদীন নামে পরিচয় দেওয়া ওই ব্যক্তি।
সকাল ১১টায় ট্রেনটির কমলাপুর স্টেশন ছাড়ার কথা। কিন্তু প্রায় আধ ঘণ্টার বেশি দেরিতে কমলাপুর ছাড়ে চট্টলা এক্সপ্রেস।

এদিকে ট্রেন ছাড়ার মিনিট দুয়েক আগে তাড়াহুড়ো করে বাবুলকে মালগাড়ির দিকে টেনে নিয়ে যান জয়নাল। ওই গাড়ির ভেতর থেকে আসা পচা মাছের উৎকট গন্ধে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছিল বাবুল ও তার ছেলে-মেয়ের। কিন্তু কী আর করা, তাই নাক চেপে উঠলেন ট্রেনে।

‘বাড়িতে তো যেতেই হবে, তাই ট্রেনের মালগাড়িতে বসেই রওনা দিয়েছি’- বলছিলেন বাবুল।

মালগাড়িতে অবস্থান করে সরেজমিনে দেখা যায়, শুধু বাবুলই নয়, তার মতো আরও ১৭ জনের মতো নারী-পুরুষ-শিশুকে মালগাড়িতে তোলা হয়েছে। সবাই অন্যকোনো উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়েই ভৈরব, আখাউড়া, চট্টগ্রাম কিংবা নিজ নিজ গন্তব্যে যাচ্ছেন।

মালগাড়িতে বসা যাত্রীরা বাংলানিউজকে জানান, গন্তব্য অনুযায়ী তাদের কাছ থেকে সর্বনিম্ন ৫০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ১৫০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে।

কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরের মো. মোদাচ্ছের আলী বলেন, ‘আমার মামা শ্বশুর অসুস্থ। স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামে যাচ্ছি। কোনো আসন পাইনি। টিকিট কাটি নাই। ৫০ টাকা দিয়ে মালগাড়িতে করেই রওনা দিয়েছি। ’

সরেজমিনে দেখার জন্য ট্রেনের অন্য বগি থেকে মালগাড়িতে উঠতে চাইলে চেঁচিয়ে এলেন এক ট্রেনকর্মী। ‘এখানে জায়গা নাই। অন্য বগিতে যান!’

তবে ভাড়া দেওয়ার কথা বললে, বগির ফ্লোরে কম্বল বিছিয়ে জায়গা করে দেন জয়নাল আবেদীন। বসতে বসতে ভাড়া চাইতেও দেরি করলেন না তিনি! ‘একশ টাকা দুইজন। কম নাই। এতে অনেকেরে ভাগ দিতে অইবো। ’

ভৈরবগামী রবিউল আলম বাংলানিউজকে বলেন, মালগাড়িতে যাত্রী নেওয়ার সময় দরজা খোলা রাখা হয়। অনেক যাত্রীই দরজা দিয়ে ঝুলে থাকেন। এটা দুর্ঘটনারও কারণ হতে পারে।  

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলের একজন টিটি জানান, প্রতিটি বগিতে ৬৭টি আসন আছে। এরমধ্যে ১ থেকে ৬০ নম্বর পর্যন্ত আসন কাউন্টারে বিক্রি হয়। বাকি সাতটি আসন স্টাফদের জন্য বরাদ্দ। এরমধ্যে আবার ট্রেনের গার্ড (পরিচালক) থেকে শুরু করে আনসার সবাইকে ভাগ দিতে হয়।

জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘৫০ শতাংশ গার্ডকে দিতে হয়। আর ৫০ শতাংশ আমরা নেই। বড় থেকে ছোট সবাইকে ম্যানেজ করেই আমাদের নিতে হয়। এভাবে ট্রেনের যেসব স্টাফ আছে সবাই যে যার মতো যাত্রী তোলে, কোনো ভালো মানুষি নেই। এভাবে দৈনিক গড়ে সর্বনিম্ন ৫০০, সর্বোচ্চ দেড় হাজার টাকাও হয়। ’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক কর্মী বলেন, যাত্রার সময় বিভিন্ন জায়গায় অনির্ধারিত যাত্রা বিরতি হয়। সেটা ক্রসিংয়ের কারণে আবার অনেক সময় ড্রাইভার যেসব লোক গাড়িতে ওঠায় তাদের নামানোর জন্য স্লো করে।

এদিকে ট্রেনের যাত্রী সেবার মান এবং ব্যবস্থাপনা নিয়ে যাত্রীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। ট্রেনের ‘ন’ বগির ৬০ নম্বর আসনের আবদুল আলীম বলেন, ‘ট্রেনে কি উৎকট গন্ধ! একটু পর পর অনির্ধারিত যাত্রা বিরতি। শীতের মধ্যে ফ্যান চলছে, দুপুর ১২টার সময় জ্বলছে বাতি। যেন দেখার কেউ নেই। ’

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে চট্টলা এক্সপ্রেসের পরিচালক (গার্ড) কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৫
এমএ/এমজেএফ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।