ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

বালাসী-বাহাদুরাবাদ ঘাট-৩

বাঁশিতে ফু’ দিয়ে ডাকাত প্রতিরোধ!

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৪২ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩০, ২০১৫
বাঁশিতে ফু’ দিয়ে ডাকাত প্রতিরোধ! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বাহাদুরাবাদ (জামালপুর) ঘাট থেকে ফিরে: নৌকায় পিনপতন নিরবতা। রেজা মাঝি ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলেন।

কিছু খুঁজছেন মনে হয়! ছোট্ট করে জবাব দিলেন, এখানে ডাকাতি হয়।
 
জায়গার নাম জানালেন তিনখোপা। দেখতে অনেকটা ইংরেজির এক্স’র মতো। চারটি ধারা বহমান। প্রস্থে কোনোটিই দেড় কিলোমিটারের কম নয়। যতোদূর চোখ যায়, কোনো জনবসতি নেই। শুধু ধু-ধু বালুচর। একটি ধারা দক্ষিণে ফুলছড়ি থানার টেংরাকান্দি, একটি উত্তরে গোলাবাড়ি, পশ্চিমে খাটিয়াবাড়ি (তালতলা বাজার), অপরটি দেওয়ানগঞ্জের দিকে বহমান।
 
দেখলেও গা ছমছম করে ওঠে। মাছ ধরার নৌকাও নাকি এদিক আসে না। নৌকায় যারা পাশের যাত্রীর সঙ্গে টুকটাক কথা বলছিলেন, তারাও পুরোপুরি চুপ হয়ে গেলেন অজানা শঙ্কায়।

কিছুদূর যাওয়ার পর রেজা মাঝি দূরে হাত দেখিয়ে বললেন, ওই যে পুলিশের নৌকা। তার কথায় যাত্রীরা যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। বুক ভরে শ্বাস নিলেন অনেকে। কারণ, এখানে সব সময় পুলিশ থাকে না। আর পুলিশ না থাকা মানে অঘটনের শঙ্কা।

যাত্রীরা জানালেন, দুপুর দেড়টায়ই এ অবস্থা! রাত হলে কি হতে পারে তা সহজেই বোঝা যায়। রাতে সাধারণ মানুষ দূরের কথা, অল্প সংখ্যক পুলিশ সদস্যও যাওয়ার সাহস ‍পান না। পুলিশকে যেতে হলে দলবেধে যায়।
 
ফুলছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আতিয়ার রহমান বলেন, আমাদের যে স্পীডবোটগুলো আছে, সেগুলো খুবই ছোট। চারজনের বেশি ওঠা যায় না। ড্রাইভারকে বাদ দিলে মাত্র তিনজন ওঠা যায়। তিনজন নিয়ে পাহারা দিতে যাওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

তিনি বলেন, বন্যার সময় সাধারণত ডাকাতের আনাগোনা বেড়ে যায়। তখন জামালপুর জেলা পরিষদের বড় স্পিডবোট এনে পাহারা দেওয়া হয়েছিলো। এখন পানি কমে গেছে, তাই নৌকা দিয়েই পাহারা দেওয়া হচ্ছে।
 
পারাপারের পথে তিন পয়েন্টে তিনটি টহল পুলিশের নৌকা দেখিয়ে দেন মাঝি। নৌকাগুলো এতোদূরে (তীরে) অবস্থান করছিল যে, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। অনেকটা খেলনা নৌকার মতো দেখাচ্ছিল। নৌকাগুলোতে বাঁশের মাথায় পতাকা উড়ছে বলেই চেনা যায় যে, ওগুলো পুলিশের নৌকা। অন্য কোনো নৌকায় পতাকা থাকে না।

গাইবান্ধার ফুলছড়ি ও জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ থানার দুই সীমানায় হওয়ায় দু’টি থানার পক্ষ থেকেই পাহারা দেওয়া হয়। তবে কোনো ডিউটির নৌকাই বিকেলের পর আর থাকে না বলে জানান নৌকার মাঝিরা।

দেওয়ানগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসলাম হোসেন বাংলানিউজকে জানান, বিকেল পর্যন্ত ঘাটে নৌকা চলাচল করে। তাই ততোক্ষণ পর্যন্ত পাহারা দেওয়া হয়। এরপর প্রয়োজন হলে অবশ্যই পুলিশ পাঠানো হয়।
 
দিনের কোন সময়ে পাহারা দেওয়া হয় জানতে চাইলে আসলাম হোসেন বলেন, সারাদিনই পাহারা দেয় পুলিশ। আর নৌকায় একজন করে অফিসার আর ৪ থেকে ৫ জন কনস্টেবল থাকে। স্পিডবোট থাকলেও জ্বালানি সংকটের কারণে ব্যবহার করা যাচ্ছে না।
 
তিনি বলেন, পরিস্থিতি এখন অনেক ভালো। আগে রাতে চরের গ্রামগুলোতে হামলা করতো ডাকাতরা। আমরা স্থানীয়দের সচেতন করেছি। তারা নিজেরাই এখন ডাকাত প্রতিরোধে এগিয়ে এসেছেন।
প্রত্যেক পরিবারে বাঁশি দেওয়া হয়েছে। কোথাও ডাকাত এলেই তারা বাঁশিতে ফু’ দিয়ে এগিয়ে আসবেন। আর বাঁশির শব্দে অন্যরাও এগিয়ে আসবেন। এ পদ্ধতি বেশ কাজে দিয়েছে। যে কারণে এখন ডাকাতি কম হয় বলে দাবি করেন আসলাম হোসেন।
 
বাহাদুরাবাদ ঘাটে ১৯৭৬ সালে স্থাপন করা হয় ভাসমান নৌ-থানা। কিন্ত স্টিমার বন্ধ হওয়ার পর ভাসমান থানাটি সরিয়ে নেওয়া হয়। ২০০৯ সালে  যমুনার ভাঙনে নৌ-থানার ভবনটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এখন মলমগঞ্জের একটি কলেজ ভবনে পরিচালিত হচ্ছে নৌ-থানার কার্যক্রম।
 
আগে এ রুট দিয়ে উত্তরবঙ্গের রেলওয়ের যাত্রীরা যাতায়াত করতেন। তখন এ স্টিমার চলাচল করতো। এপার আর ওপারের ট্রেনের সময় ছিল মেলানো। বালাসী ঘাটে ট্রেন থেকে নেমে স্টিমারে উঠতে হতো। আর স্টিমার বাহাদুরাবাদ ঘাটে পৌছলে ঢাকার উদ্দেশ্যে ট্রেন ছেড়ে যেতো। বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার পর ট্রেনগুলো বগুড়া, শান্তাহার নাটোর ঘুরে ঢাকা যাতায়াত করছে। তাই স্টিমার বন্ধ। আর স্টিমার বন্ধ করায় নৌকাই একমাত্র ভরসা।
 
কিন্তু সেই নৌকার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন যাত্রীরা। তারা অভিযোগ করেছেন, পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেই ডাকাতি হয়। না হলে এতো ডাকাতি হয়, ডাকাত ধরা পড়ে না কেন? অন্যদিকে পুলিশ জানিয়েছে, তারা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় থাকার কারণে অনেক সময় ডাকাতদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেওয়া যায় না।

এখান থেকে খুব কাছেই বাংলাদেশ ভারতের নদীপথের সীমান্ত এলাকা কুড়িগ্রামের রাজিবপুর উপজেলা। যে কারণে মাদকপাচারের অন্যতম রূট হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে এলাকাটি। ভূ-কাঠামোগত কারণে এখানে কোনো সড়ক যোগাযোগ নেই। নৌকা আর পায়ে হাঁটা ছাড়া কোনো বিকল্পও নেই।
 
বহ্মপুত্র যেনো নিজেকে উজাড় করে মেলে ধরেছে এখানে। একাধিক ধারা বহমান। প্রায় ২২ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত নদী। আর সেই নদীর ভেতরে বিশাল বিশাল চর ‘সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অচেনা কোনো ব্যক্তিকে দিনেও ছেড়ে দিলে বেরিয়ে আসা তারপক্ষে খুবই কঠিন।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৪১ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩০, ২০১৫
এসআই/এএসআর

** বালাসী-বাহাদুরাবাদ ঘাট-২: ডাকাত যাওয়ার পরে দেখা মেলে পুলিশের!

** বালাসী-বাহাদুরাবাদ ঘাট-১: অচিহ্নিত-অনিরাপদ অদ্ভুত এক নৌ-রুট!

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।