ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

‘অপরাধ স্বীকার করে শুধু মৃত্যুদণ্ড থেকে অব্যাহতি চান নিজামী’

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২, ২০১৫
‘অপরাধ স্বীকার করে শুধু মৃত্যুদণ্ড থেকে অব্যাহতি চান নিজামী’ মাহবুবে আলম ও খন্দকার মাহবুব হোসেন

ঢাকা: ‘জামায়াতের পক্ষ থেকে তাদের শীর্ষ আইনজীবীরা এই প্রথম তাদের একজন অভিযুক্ত নেতা যে অপরাধী সেটা স্বীকার করে নিলেন এবং স্বীকার করে নিয়ে শুধু মৃত্যুদণ্ডের হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য আবেদন করলেন’।

বুধবার (০২ ডিসেম্বর) দুপুরে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর আপিল শুনানিতে যুক্তি উপস্থাপনের পর এমন মন্তব্য করলেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।



অ্যাটর্নি জেনারেল আরও মন্তব্য করেন, সাজা বাড়ানো-কমানো আদালতের ব্যাপার। তবে সাজা কমবে- এটা আমি বিশ্বাস করি না।

অন্যদিকে আসামিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের পর নিজামীর প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, আমরা বলেছি, ‘জামায়াতের সদস্য হিসেবে তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের অখণ্ডতায় বিশ্বাস করতেন। সেই বিশ্বাস থেকে পাকিস্তান বাহিনী যারা এখানে ছিলেন তাদেরকে তারা মোরাল সাপোর্ট দিয়েছেন। রাজনৈতিকভাবে সমর্থন দিয়েছেন’।

তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে তাকে। অনেক চার্জে তার খালাস পাবার সম্ভাবনা আছে। তারপরেও কোনো চার্জে যদি সাজা দেন, তাহলে তাকে আদালত চরম দণ্ড দেবেন বলে আমি বিশ্বাস করি না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

বুধবার আপিল শুনানির নবম কার্যদিবসে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে যুক্তিতর্ক শেষ করেন আসামিপক্ষ। এরপর রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। আগামী ০৭ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করার দিন ধার্য রয়েছে।

প্রথমদিনের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন অ্যাটর্নি জেনারেল। তিনি বলেন, আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক শেষ হয়েছে। অর্থাৎ নিজামীর পক্ষের আইনজীবীরা তাদের বক্তব্য বুধবার সমাপ্ত করেছেন। রাষ্ট্রপক্ষে আমাকে আগামী ০৭ ডিসেম্বর একটি দিন ধার্য করা হয়েছে আমার বক্তব্য প্রদানের জন্য।

অ্যার্টনি জেনারেল সাংবাদিকদের বলেন, বক্তব্য শেষ করার শেষ প্রান্তে তারা (আসামিপক্ষ) যেটা বলেছেন, তাদের শীর্ষ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, ‘এটাতো ঐতিহাসিক ঘটনা যে, খুন বা মানুষ হত্যা এগুলো হয়েছে। এবং এগুলোর সঙ্গে জামায়াত সে সময় সহযোগিতাও করেছে। মতিউর রহমান নিজামী তার বিশ্বাস থেকেই এগুলোকে সমর্থন করেছেন’।

শেষ মুহূর্তে তিনি (খন্দকার মাহবুব) বলেছেন, ‘এগুলো যদি করেও থাকেন, তবুও বয়সের কথা চিন্তা করে তাকে মৃত্যুদণ্ড থেকে অব্যাহতি দেওয়ার অনুরোধ করছি’ বলেও জানান অ্যাটর্নি জেনারেল।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মাহবুবে আলম মন্তব্য করেন, ‘তারা সাবমিশন যা করেছেন, আমি যা বুঝেছি, তাতে আমার মনে হল, জামায়াতের পক্ষ থেকে তাদের শীর্ষ আইনজীবীরা এই প্রথম তাদের একজন অভিযুক্ত নেতা যে অপরাধী সেটা স্বীকার করে নিলেন এবং স্বীকার করে নিয়ে শুধু মৃত্যুদণ্ডের হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য আবেদন করলেন। এটা আমি যা বুঝেছি সেটিই আপনাদের বললাম’।

‘ফৌজদারি মোকদ্দমায় এটা একটা আসামি বিকল্প আগুমেন্ট সব সময় করতে পারে। তারা ফ্যাক্টের ব্যাপারে অস্বীকার করে আবার অল্টারনেটিভলি এ কথাও বলতে পারেন, হ্যাঁ, এগুলো করেছেন ঠিকই। তারপর আমি মৃত্যুদণ্ডের হাত থেকে রক্ষা পেতে চাই’।

মাহবুবে আলম বলেন, ‘জামায়াতের মামলার ব্যাপারে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের থেকে দোষ স্বীকার করে নেওয়ার ব্যাপারে এরকম স্পষ্ট বক্তব্য আমি এই প্রথম দেখলাম। দোষ স্বীকার করে নেওয়ার অর্থ হল, তাদের বক্তব্যের ভেতরে তারা বলেছেন, হ্যাঁ, ঘটনাগুলো ঘটেছে, তারা (যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার-আলবদররা) এগুলোর ভেতর যুক্ত ছিলেন, এটা আজকে ঐতিহাসিক সত্য। তারপরও তারা এটা করেছেন তাদের বিশ্বাসের থেকে। তাই এখন যেহেতু তার (নিজামীর) বয়স হয়ে গেছে ৭৩-৭৪ বছর, তাকে ফাঁসি দিয়ে কী হবে, অপরাধের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া যেতে পারে।

অপরাধ স্বীকারের এ রকম স্পষ্ট বক্তব্য এটাই প্রথম বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

তিনি বলেন, সাজা বাড়ানো-কমানো আদালতের ব্যাপার। তবে সাজা কমবে- এটা আমি বিশ্বাস করি না।

এদিকে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে নিজামীর প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের মূল বক্তব্য জামায়াত এবং জামায়াতের সদস্য হিসেবে তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের অখণ্ডতায় বিশ্বাস করতেন। সেই বিশ্বাস থেকে পাকিস্তান বাহিনী যারা এখানে ছিলেন তাদেরকে তারা মোরাল সাপোর্ট দিয়েছেন। রাজনৈতিকভাবে সমর্থন দিয়েছেন।

কিন্তু নিজামীর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছিলো, যেসব অভিযোগ হলো, সেখানে নির্দিষ্ট ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে- খুন ধর্ষণ এবং লুণ্ঠন। বিশেষ করে চারটি অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সেখানে স্পেসিফিক অকারেন্স দেওয়া আছে।

খন্দকার মাহবুব বলেন, সেক্ষেত্রে আমরা বলেছি, এটা আমাদের দুর্ভাগ্য যে, এ মামলায় যারা সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাদেরকে দীর্ঘদিন ধরে সেফহোমে রেখে প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী) প্রসিকিউশন না করে আসামিদের সাজা কিভাবে হয় পার্সিকিউশন করার জন্য সাক্ষীদের টু টট করেছেন, আদালতে কি বলতে হবে। এ কারণে যারা তদন্ত কর্মকর্তা তাদের কাছে এ সাক্ষীরা যে রকম বক্তব্য দিয়েছেন আর আদালতে এসে ভিন্নভাবে কথা বলেছেন।
‘এ থেকে প্রমাণ হবে, প্রসিকিউশন আসামিকে সাজা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তাদেরকে শিখিয়ে পড়িয়ে ভয় দেখিয়ে আদালতে উপস্থাপন করেছেন’।

‘তারপরেও তখনকার বাংলাদেশটা পাকিস্তান আর্মির অধীনে ছিলো। দেশে ভয়াবহ আর্মি আতঙ্ক ছিলো। সে আতঙ্কের সময় নিজামী সাহেব ১৯ /২০ বছরের একজন সাধারণ ছাত্র ছিলেন। ওই সময় প্রতাপশালী আর্মিকে সহযোগিতা করা বা তাদেরকে বলা, এটা করো ওটা করো, পথ দেখিয়ে দেওয়া- এই ক্ষমতা কমান্ড রেসপন্সিবিলিটি তার ছিল না। তারপরও আমরা দেখেছি, চারটা চার্জে (অভিযোগে) তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে’।

তিনি বলেন, প্রসিকিউশন থেকে প্রমাণ করলেন, মে মাসে ৩১ মে বা ২৬ মে আলবদর গঠন করা হয়। এটা আর্মির নিয়ন্ত্রণে করা হয়েছে। দুই চার্জে আলবদর কমান্ডার হিসেবে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। যখন আলবদর হয়নি, তখন আলবদর কমান্ডার হিসেবে তাকে (নিজামী) ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। এটা সঠিক নয়। পরবর্তী ঘটনার সময় নিজামী ইসলামী ছাত্রসংঘের দায়িত্বে ছিলেন না।

খন্দকার মাহবুব হোসেনের দাবি, অনেক চার্জে নিজামীর খালাস পাবার সম্ভাবনা আছে। তারপরেও কোনো চার্জে যদি সাজা দেন, তাহলে তাকে চরম দণ্ড দেবেন বলে আমি বিশ্বাস করি না।

নিজামীর বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড এবং হত্যা-গণহত্যাসহ সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটির (ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়) মোট ১৬টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে ৮টি অর্থাৎ ১, ২, ৩, ৪, ৬, ৭, ৮ ও ১৬ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয় ট্রাইব্যুনালের রায়ে।
 
প্রমাণিত চারটি অর্থাৎ সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়িসহ দু’টি গ্রামে প্রায় সাড়ে ৪০০ মানুষকে গণহত্যা ও প্রায় ৩০-৪০ জন নারীকে ধর্ষণ (২ নম্বর অভিযোগ), করমজা গ্রামে ১০ জনকে গণহত্যা, একজনকে ধর্ষণসহ বাড়ি-ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ (৪ নম্বর অভিযোগ), ধুলাউড়ি গ্রামে ৫২ জনকে গণহত্যা (৬ নম্বর অভিযোগ) এবং বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ও সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটির (১৬ নম্বর অভিযোগ) দায়ে নিজামীকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়।

অন্য চারটি অর্থাৎ পাবনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাওলানা কছিমুদ্দিন হত্যা (১ নম্বর অভিযোগ), মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র (৩ নম্বর অভিযোগ), বৃশালিখা গ্রামের সোহরাব আলী হত্যা (৭ নম্বর অভিযোগ) এবং রুমী, বদি, জালালসহ সাত গেরিলা যোদ্ধা হত্যার প্ররোচনার (৮ নম্বর অভিযোগ) দায়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।

৫ ও ৯ থেকে ১৫ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় এসব অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছেন তিনি। এগুলোও ছিল হত্যা-গণহত্যা, আটক, অপহরণ, নির্যাতন, বাড়ি-ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ এবং বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের উস্কানি ও প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ।

বাংলাদেশ সময়: ১৬০৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০২, ২০১৫
ইএস/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।