আব্দুল বাতেন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) রমনা ডিভিশনের উপ-কমিশনার (ডিসি)।
সম্প্রতি বাংলানিউজের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ পুলিশের সাফল্য, ব্যর্থতা, সীমাবদ্ধতা, স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, পুলিশের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক ও পুলিশ সম্পর্কে নানা শ্রেণী-পেশার মানুষের ধারণা এবং নিজের পেশাগত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন ডিসি আব্দুল বাতেন। স্বাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাংলানিউজের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট আবাদুজ্জামান শিমুল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট নুরুল আমিন, শেখ জাহাঙ্গীর আলম ও কাজী নাজমুল হক ফয়সাল। বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য স্বাক্ষাৎকারটির চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো।
দেশের যে কোনো প্রান্তে কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সবার আগে প্রশ্ন ওঠে বাংলাদেশ পুলিশের দক্ষতা নিয়ে। বিষয়টি উড়িয়ে না দিয়ে সাক্ষাৎকারের শুরুতেই এ নিয়ে নিজের মতামত দেন ডিসি আব্দুল বাতেন।
তার মতে, দক্ষতায় নয়, বাংলাদেশের পুলিশ এখনও পিছিয়ে রয়েছে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার অভাবে। আন্তর্জাতিকভাবে পুলিশের মৌলিক কাঠামো একই। প্রয়োগের ক্ষেত্রে এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের পার্থক্য দেখা যায়। তবে পুলিশকে সাধারণ মানুষের আরও কাছাকাছি যেতে হবে এই মত দিয়ে তিনি বলেন, জনতা ও পুলিশ পরস্পর পরস্পরের বন্ধু হতে পারলেই পুলিশের অবদান আরও বাড়বে।
উল্টো প্রশ্ন আব্দুল বাতেনের, মানবিক গুণাবলি না থাকলে আপনি কিসের মানুষ? পুলিশ, সাংবাদিক, আইনজীবী ও ডাক্তার- যেই হোন না কেন, আমাদের মূল পরিচয় একটাই, আমরা মানুষ। একজন মানুষ হিসেবে যেসব মানবিক গুণাবলি থাকা প্রয়োজন তা শুধু পুলিশের থাকতে হবে তা নয়, এসব মানবিক গুণাবলী সব শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যেই থাকা দরকার। এতে সবার কাজ করতে সুবিধা হয়।
উপ-কমিশনার বলেন, পুলিশের ব্যাপারে মানুষের যে নেতিবাচক ধারণা তা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। এই ধারণা পরিবর্তন করতে নতুন প্রজন্মের পুলিশ সদস্যরা কাজ করছেন। আশা করি খুব দ্রুতই এ ব্যাপারে মানুষের চিন্তা চেতনায় পরিবর্তন আসবে।
আব্দুল বাতেন মনে করেন, পুলিশি সেবার মূল জায়গা হচ্ছে পুলিশ স্টেশন। একজন নাগরিক থানায় গেলেই সেবা পাবেন- এমন আস্থা নাগরিকদের মধ্যে এখনো তৈরি করতে পারেনি পুলিশ। নাগরিকদের মধ্যে এই নির্ভরশীলতার জায়গা তৈরি করতে হলে পুলিশের আচরণে ও সেবার মানে আরো পরিবর্তন আনতে হবে।
পুলিশ যদি তাদের আচরণ পরিবর্তন করতে না পারে, তাহলে শুধু কাগজে কলমে পুলিশ জনগণের বন্ধু লিখে লাভ হবে না।
পৃথিবীর কোন দেশেই নাগরিকরা পুলিশকে বন্ধু মনে করে না। তবে অন্যদেশের নাগরিকরা এটুকু মনে করে, পুলিশের কাছে গেলে তারা আইনি সহায়তাটুকু পাবে।
দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পুলিশ বরাবরই সমালোচনার মুখে পড়ে; এটি এড়ানো সম্ভব কি না?
এ ব্যাপারে আব্দুল বাতের মূল্যায়ন হলো-পুলিশ সব সময় থাকে উভয় সংকটে। এক সঙ্গে সব পক্ষকে খুশি করা পুলিশের পক্ষে সম্ভব না। ধরুন কোন একটি গোষ্ঠী তাদের যৌক্তিক দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছে। এতে রাস্তা বন্ধ হয়ে দুর্ভোগে পড়ে সাধারণ মানুষ। জনদুর্ভোগ লাঘব করতে এবং আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে রাস্তায় নামা মানুষদের তুলে দিতে গেলে তারা বলেন, আমরা যৌক্তিক দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছি। পুলিশ আমাদের তুলে দিচ্ছে কেন?
অপরদিকে অবরোধকারীদের তুলে না দিলে দুর্ভোগে পড়া সাধারণ মানুষ বলে, পুলিশ বসে বসে তামাশা দেখছে। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশের করণীয় কী? তবে আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে এমন কোনো আচরণ করা উচিত নয়; যে আচরণে অন্যের ক্ষতি হয়।
জাতিসংঘের শান্তি মিশনে দায়িত্ব পালন করতে ২০০৪ সালে কসোবোতে যান আব্দুল বাতেন। সেখানকার পুলিশ ও নাগরিকদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তিনি।
বাংলানিউজজের সঙ্গে সে অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে গিয়ে একটি ঘটনা শোনালেন।
‘কসোবোর রাস্তায় ইউনিফর্ম পড়ে গাড়ি চালাচ্ছিলাম। এ সময় এক নাগরিক রাস্তা পার হচ্ছিলেন। আমি বুঝতে না পেরে তার খুব কাছে গিয়ে গাড়ি থামাই। ওই পথচারি আমার এই আচরণে খুবই ক্ষুদ্ধ হন। আমি তাকে ‘সরি’ বলি। পরে জানতে পারি, কসোবোর নিয়মানুযায়ী পথচারিরা রাস্তা পারপারে অগ্রাধিকার পাবে। গাড়ি থামিয়ে পথচারিদের রাস্তা পারাপারে সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে ঘটে উল্টো ঘটনা।
‘ক্রাইম’ এবং ‘ল এন্ড অর্ডার’ দুটি আলাদা বিষয়। কিন্তু অপরাধ দমনের চেয়ে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বেশি সময় ব্যয় করছে বাংলাদেশ পুলিশ- এ বিষয়টি পীড়া দেয় আব্দুল বাতেনকে।
তার পর্যবেক্ষণ হলো- ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ সদস্য ব্যস্ত থাকেন আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ রাখতে। ফলে অপরাধ দমনে কাজ করার সময় কম পাওয়া যায়। ডিএমপির পুলিশ সদস্যরা যদি অপরাধ দমন ও ঘটনার তদন্তে বেশি সময় দিতে পারত; তাহলে রাজধানীতে অপরাধ অনেকাংশেই কমে আসত।
তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও অপরাধ দমনে পুলিশ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন আব্দুল বাতেন।
তিনি বলেন, দেশে বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা পৃথিবীতে প্রযুক্তি ব্যবহারের করে অপরাধ করছে অপরাধিরা। আর তাদের মোকাবেলা করতে প্রযুক্তিগতভাবে শক্তিশালী হচ্ছে পুলিশ। এর ধারবাহিকতায় আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত হচ্ছে পুলিশ বাহিনীতে।
উপ-কমিশনার আব্দুল বাতেন জানান, অপরাধ দমনে পুলিশ দুই ধরনের কাজ করে থাকে। ক্রাইম প্রিভেনশন ও ডিটেকশন। প্রথমত পুলিশ কোন অপরাধ ঘটার আগেই ব্যবস্থা গ্রহণের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। সেটা সম্ভব না হলে ঘটনা তদন্ত করে অপরাধীদের বের করে দৃষ্টান্ত স্থাপনের চেষ্টা করা হয়।
বিদেশি নাগরিক, ব্লগার ও প্রকাশকদের টার্গেট করে হত্যা- এ ব্যাপারে ডিসি আব্দুল বাতেনের ব্যাখা হলো- আদর্শগত দ্বন্দ্বের কারণেই সংগঠিত হচ্ছে টার্গেট কিলিং। তাই ঘটনার পূর্বে এগুলো চিহ্নিত করা খুবই কঠিন। এ ধরনের অপরাধ দমনে মানুষকে সচেতন করতে হবে। প্রয়োজনে মোটিভেশনাল ইনিস্টিটিউট গড়ে তুলে, গণমাধ্যমের সহায়তা নিয়ে ও নানা সচেতনতামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে মানুষের কাছে সঠিক ব্যাখা তুলে ধরতে হবে।
নানা অভিজ্ঞতায় হৃদ্ধ ডিসি আব্দুল বাতেন পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখিয়ে স্বীকৃতিও পেয়েছেন।
গাজীপুরে দায়িত্ব পালনের সময় ২০০৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি নিজ দপ্তরে সংবাদ সম্মেলন করছিলেন আব্দুল বাতেন। ঠিক সেই মুহূর্তে বোমা হামলা চালায় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)। পরে ওই হামলার ঘটনায় জড়িত জেএমবি সদস্যদের গ্রেফতার ও বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক উদ্ধারে নেতৃত্ব দেন তিনি।
এ ছাড়া গাজীপুরে দায়িত্ব পালনকালে এক পুলিশ সদস্যসের অস্ত্র ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অস্ত্র উদ্ধার করে জড়িতদের গ্রেফতার করা হয়।
এই দুটি কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১০ সালে পিপিএম (প্রেসিডেন্ট পুলিশ পদক) পান আব্দুল বাতেন।
বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিলে আব্দুল বাতেন বলেন, যে কোনো ধরনের স্বীকৃতি কাজের গতি বাড়িয়ে দেয়। তবে বিষয়টিকে আমি ব্যক্তিগত অর্জন হিসেবে কখনো দেখি না। দেখি পুরো পুলিশ বাহিনীর অর্জন হিসেবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৪, ২০১৫
এজেডএস/এনএ/এসজেএ/এনএইচএফ/এজেড/এমএমকে
জাতীয়
বাংলানিউজকে রমনা ডিসি আবদুল বাতেন
পুলিশের যেকোনো অর্জনই বাহিনীর, ব্যক্তিগত নয়
... | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।