ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

একটি অনন্য সাফল্যের গল্প!

সাজেদা সুইটি, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৩৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৬, ২০১৫
একটি অনন্য সাফল্যের গল্প! ছবি: কাশেম হারুণ/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: ধর্মযাজকরা বলেন, ‘কে কখন কার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে ধরা দেবে তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন। কোনো কোনো মানুষ অন্য মানুষের জীবনে সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধি হিসেবে হাজির হন।


 
এখানে গল্পটি সেরকমই।  

শাহ মাহমুদ সায়েমের জন্মের কিছু সময়ের মধ্যেই স্বজনরা টের পেলেন- অচেনা বড় ব্যাধি নিয়ে জন্মেছে শিশু। প্রস্রাবে কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না তার, অনবরতই হচ্ছিল, যখন তখন।

একে একে অনেক ডাক্তার-বৈদ্যি, চেষ্টার কোনো অন্ত রাখলেন না মা-বাবা। ডাক্তাররা হাল ছেড়ে বলেন, এ চিকিৎসা বাংলাদেশে হবে না, ইংল্যান্ডে হতে পারে।  

মাথায় যেন বাজ পড়ে অভিভাবকদের। এতদিনে চিকিৎসায় বেশ খরচা হয়ে গেছে। ইংল্যান্ডে যাতায়াত, অবস্থান ও চিকিৎসার খরচ জোগানোর সাধ্য ভেবে পাচ্ছিলেন না তারা।

বয়স বদলায়, যৌবনে পা রাখেন সায়েম। কিন্তু ডাক্তারদের ভাষ্য বদলায় না।
 
একসময় সেনাবাহিনীর অধ্যাপক চিকিৎসক মেজর জেনারেল সিরাজ জিন্নাতের দুয়ারে কড়া নাড়েন সায়েম।
 
কিন্তু অভিজ্ঞ এ ডাক্তারের বয়স হয়েছে। বুঝলেন- চিকিৎসাটি সময় সাপেক্ষ, ধৈর্য্যেরও বটে, ফলও পুরোপুরি অনিশ্চিত। বাংলাদেশে এ রোগের চিকিৎসা আগে কখনো হয়নি।
 
দেখে-শুনে সায়েমকে সিরাজ জিন্নাত তার প্রিয় ছাত্রের কাছে পাঠালেন। সঙ্গে একটি চিঠি, ‘তরুণ ডাক্তার, এ তরুণ রোগীকে দেখ তো। ’

গুরুর মান রেখেছেন সেই ছাত্র, বাংলাদেশে এমন জটিল রোগের সর্বপ্রথম সফল অপারেশন করেছেন, জিতেছেন স্বর্ণপদক।
 
সেনাবাহিনী থেকে তিনিই প্রথম এ স্বর্ণপদক পাওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন, আর দেশ থেকে এমন পদক পাওয়াদের মধ্যে তিনি ১০ম।
 
সেনাবাহিনীর কনসালট্যান্ট সার্জন জেনারেল ও চিফ ইউরোলজিস্ট মেজর জেনারেল হারুনুর রশিদ ও সায়েমের মুখ থেকেই শোনা এ গল্প।

শিক্ষকের চিঠি হাতে ২৫ বছরের সায়েম ডা. হারুনুর রশিদের জীবনে চ্যালেঞ্জ হিসেবে এলেন, জীবনের সবচে বড় অ্যাসাইনমেন্টও বটে।
 
জন্মগত জটিল এ রোগের (অ্যাডাল্ট ব্লাডার এক্সট্রফি- এপিসপ্যাডিয়াস) চিকিৎসা শুরু করলেন ডা. হারুন। ১৯৯৬ সাল থেকে চিকিৎসা শুরু করে অপারেশনটি করেন ১৯৯৭ সালে। বাংলাদেশে এমন অপারেশন এই প্রথম, সাফল্যের আশা প্রায় ছিলই না। কিন্তু সাফল্য পেলেন তিনি।  

শনিবার (০৫ ডিসেম্বর) রাজধানীতে আয়োজিত ১৩তম ‘ইন্টারন্যাশনাল সার্জিক্যাল কংগ্রেস’ এবং ‘সার্ক সার্জিক্যাল কংগ্রেস’- এ পাওয়া গেল ডাক্তার-রোগী উভয়কেই। যার যার পরিবার নিয়ে এসেছিলেন তারা।
 
সায়েমের বয়স এখন ৪২ বছর। ২০০০ সালে ঊর্মিকে বিয়ে করে এখন দু’সন্তানের জনক-জননী তারা। বড় মেয়ে সুমাইয়া (১১) ও ছোটমেয়ে স্বর্ণাকে (৩) নিয়ে তাদের সংসার।  
 
স্বামীর অসুস্থতা নিয়ে আক্ষেপ করেন না ঊর্মি। বাংলানিউজকে বললেন, অসুস্থতা তো বিয়ের পরেও হতে পারতো, বড় দুর্ঘটনায় পড়তে পারে মানুষ। তাই অসুস্থ শুনে বিয়ে না করা- এটা আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয়। তার পাশে তো কাউকে দাঁড়াতেই হবে। তাছাড়া বিয়ের আগেই তার অপারেশন হয়েছে, তিনি তখন সুস্থ।
 
ডা. হারুন প্রসঙ্গে বলেন, আল্লাহর রহমতে হারুন স্যারকে পেয়েছি। স্বামী সুস্থ আছেন, আমরা ভালো আছি। ডাক্তার আমাদের কাছ থেকে ভিজিট নেন না। তবে অন্যান্য প্রেক্ষিতে বড় খরচ পড়ে যায়। কয়েক লাখ টাকা এরমধ্যে খরচ হয়েছে। আর কোনো সমস্যা নেই।
 
দুই সপ্তাহ পরে ডা. হারুন আরও একটি অপারেশন করবেন সায়েমের। সায়েমের হয়ে সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তাই সহযোগিতা চাইলেন, বললেন, বিত্তবানরা এগিয়ে এলে পরিবারটি উপকৃত হবে। (আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, নন্দীপাড়া, শাহ মাহমুদ সায়েম, সেভিংস অ্যাকাউন্ট-০৬০১১২০০৯৫৫০৭)।
 
ডা. হারুন যখন মঞ্চে নিজের অভিজ্ঞতা জানাচ্ছেন, তখন মন্ত্রমুগ্ধ চোখে তাকে দেখছিল এ পরিবার। তাদের কাছে এ ডাক্তার সবচেয়ে আপন।
 
ছোট্ট স্বর্ণা বড় মনিটরে ডাক্তারের চেহারা দেখামাত্রই হাততালি দিয়ে উচ্ছ্বাসে বলে, ‘আমাদের ডাক্তার! আব্বুর ডাক্তার!’
 
ডা. হারুন জানালেন, অনেক ভাবতে হয়েছে, সময় নিয়ে, পড়াশোনা ও রীতিমতো গবেষণা চালিয়ে অপারেশনটি করেছিলেন তিনি। আজ সায়েমের সুখী পরিবার, ফুটফুটে দু’টি কন্যাশিশু দেখে প্রাণ ভরে যায়।
 
স্বর্ণপদক গলায়, সস্ত্রীক, সায়েম পরিবারকে নিয়ে বাংলানিউজের ক্যামেরায় আসেন ডা. হারুন।
 
১৯৫৫ সালের ২১ জুন কুমিল্লায় জন্মেছিলেন এ মহতী চিকিৎসক। ১৯৭৯ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের পাট চুকিয়ে ’৮০ সালে বাংলাদেশ আর্মড ফোর্সে যোগ দেন।

এরপর থেকে একে একে নিজের যোগ্যতা ও দক্ষতা প্রমাণ করে গেছেন তিনি। শুধু দেশে নয়, ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, ভারতেও সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে এসেছেন খ্যাতিমান এ সার্জন।
 
আর্মড ফোর্সেস-এ ৩৬ বছরের বেশি সময় ধরে কর্মরত এ চিকিৎসক সমৃদ্ধ করে চলেছেন সেক্টরটিকে। তার পদক পাওয়ার খুশিতে সামিল হতে এসেছিলেন বেশ ক’জন সহকর্মীও।
 
তাদের একজন বাংলানিউজকে বলেন, রোগীরা হারুন স্যারের সঙ্গে কথা বলেই অর্ধেকখানি সুস্থ হয়ে যান, চিকিৎসায় সুস্থ হন বাকিটা। স্যারের কখনো আশা ছাড়েন না। তিনি মনে করেন, সব রোগেরই চিকিৎসা রয়েছে, চেষ্টা চালাতে হয়, উপায় খুঁজে নিতে হয়।
 
বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপে নিজেদের গল্প শুনিয়ে সায়েমের শেষ কথা-‘হারুন স্যার আমার কাছে স্রষ্টার প্রতিনিধি!’
 
বাংলাদেশ সময়: ০২৩৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৬, ২০১৫
এসকেএস/এমজেএফ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।