ঢাকা: সরকারি একক কোনো প্রকল্পে অর্থায়ন করে না অস্ট্রেলিয়া। সামনের কোনো প্রকল্পে বিনিয়োগের আশ্বাসও নেই।
দেশটির স্বেচ্ছাসেবকরা এদেশে এসে নিজেদের মতো করে কাজ করে চলে যান। অথচ সেই অস্ট্রেলিয়াই সম্প্রতি বাংলাদেশে কর্মরত স্বেচ্ছাসেবকদের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে দেশে ফিরে যেতে বলেছে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়ার কতোজন স্বেচ্ছাসেবক এদেশে কাজ করছেন, সে পরিসংখ্যান দিতে পারেনি বাংলাদেশের সমাজকল্যাণ অধিদফতর ও এনজিও বিষয়ক ব্যুরো। নিজ দেশের স্বেচ্ছাসেবকদের সঠিক তথ্য জানতে অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্র জানায়, এদেশে একটিমাত্র প্রকল্পে যৌথ বিনিয়োগে আছে অস্ট্রেলিয়া, যা অন্য উন্নয়ন সহযোগীর তুলনায় নামকাওয়াস্তে। সামনে উন্নয়নমূলক কোনো প্রকল্পে সরকারকে অর্থায়ন করবে- এমন কোনো আশ্বাসও নেই দেশটির। উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে প্রতি বছর গড়ে মাত্র ২৫ থেকে ৩০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেয় অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় ২০০ কোটি টাকা থেকে ২৪০ কোটি টাকা। অন্যদিকে সারা বিশ্বের পাশাপাশি উচ্চশিক্ষার জন্য প্রতি বছর বাংলাদেশি ছেলে-মেয়েদের সুযোগ দিয়ে আসছিল অস্ট্রেলিয়া। ২০১৬ সালের জন্য সে সুযোগও স্থগিত রেখেছে দেশটি।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশে ‘তৃতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি)’ নামক প্রাথমিক শিক্ষা খাতের একটি প্রকল্পে যৌথভাবে অর্থায়ন করছে অস্ট্রেলিয়ান এইড। এ কর্মসূচির আওতায় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৯৬০ কোটি টাকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন(ইইউ) ২৭২ কোটি টাকা, গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফর এডুকেশন (জিপিই) ৮০০ কোটি টাকা অর্থায়ন করলেও উল্লেখযোগ্য হারে অর্থায়নে অংশীদারিত্ব নেই অস্ট্রেলিয়ার।
ইআরডি সূত্র জানায়, আগামীতে কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়ে অস্ট্রেলিয়ার কাছ থেকে আশ্বাসও পাওয়া যায়নি। উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের তুলনায় নামকাওয়াস্তে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া।
ইআরডি’র উপ-সচিব তোফায়েল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, এমনিতেই অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশের আর্থিক লেনদেন কম। একটিমাত্র প্রকল্পে যৌথভাবে অর্থায়ন করছে অস্ট্রেলিয়া। এছাড়া সামনে কোনো প্রকল্পে অর্থায়নেরও কোনো সম্ভাবনা নেই।
ইআরডি সূত্র জানায়, অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশের তেমন কোনো উন্নয়ন সহযোগীও নয়। প্রতি বছর গড়ে ২৫ থেকে ৩০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেয় অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় ২০০ থেকে ২৪০ কোটি টাকা। তবে এ অনুদানেরও সবটাই এনজিও’র মাধ্যমে খরচ করা হয়। সরকারের মাধ্যমে কোনো টাকা খরচ করা হয় না।
ইআরডি সূত্র জানায়, দেশটিতে প্রতিবছর বৃত্তি নিয়ে পড়তে যান বাংলাদেশের মেধাবী ছেলে-মেয়েরা। ‘অস্ট্রেলিয়া অ্যাওয়ার্ড স্কলারশিপ’ এর আওতায় বাংলাদেশি মেধাবী শিক্ষার্থীরা দুই বছর মেয়াদী এ উচ্চশিক্ষার সুযোগ পান। তবে ২০১৬ সাল থেকে সে সুযোগও থাকছে না।
ইআরডি’র দেওয়া তথ্যে আরও দেখা গেছে, ২০১৩ সালে এদেশের মোট ৫২ জন মেধাবী শিক্ষার্থীকে অনুদানে পড়ালেখার সুযোগ দিয়েছিল দেশটি। ২০১৪ সালে এ সংখ্যা ছিল ৫১ জন। আর চলতি বছর অস্ট্রেলিয়ায় গেছেন ৫০ জন।
আরেক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, ২০১৪ সালে ২৬০ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী বিশ্বের নামি-দামি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েছিলেন। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় গেছেন ২০ শতাংশ (৫২ জন)।
অস্ট্রেলিয়ায় পড়ালেখা করতে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের পরবর্তী দুই বছরের জন্য সেদেশে যেতে ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিলের মধ্যে আবেদন করতে হয়। এরপর মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের সুযোগ দেয় অস্ট্রেলিয়া। ভাইবা বোর্ডে উপস্থিত থাকেন অস্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধি, ইআরডি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। ২০১৬ সালের জন্য মৌখিক পরীক্ষা সম্পন্ন হলেও কোনো আশ্বাস পাননি বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা।
ইআরডি’র যুগ্ম সচিব নাসির উদ্দিন খান বাংলানিউজকে বলেন, অস্ট্রেলিয়া উচ্চশিক্ষার জন্য সুযোগ দেয়। কিন্তু এবার ভাইবা পরীক্ষা নেওয়ার পরও সে সুযোগ স্থগিত করেছে। কেন স্থগিত করেছে অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশন তা স্পষ্ট করে বলেনি।
এনজিও বিষয়ক ব্যুরো সূত্র জানায়, বাংলাদেশে মোট ২ হাজার ৪৩৪টি নিবন্ধিত এনজিও আছে। এর মধ্যে দেশীয় ২ হাজার ১৮৫টি এবং বিদেশি ২৪৯টি।
অস্ট্রেলিয়াসহ বিদেশি এনজিও সংস্থাগুলো শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার, কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, ত্রাণ, গৃহায়ন ও দুর্যোগ, তথ্য এবং প্রযুক্তি ও পরিবেশ উন্নয়ন বিষয়ক কর্মসূচি নিয়ে কাজ করে। তবে কতোজন অস্ট্রেলিয়ান স্বেচ্ছাসেবক বাংলাদেশে কাজ করেন- সে তথ্য নেই এনজিও বিষয়ক ব্যুরো’তে।
সূত্র জানায়, সরকারের সঙ্গে সরাসরি মাত্র একটি প্রকল্পে যৌথভাবে কাজ করে অস্ট্রেলিয়া। বাকি প্রকল্পগুলোতে দেশি-বিদেশি এনজিও’র সঙ্গে যৌথভাবে অনুদান সহায়তা দেয় দেশটি।
ইআরডি’র দেওয়া তথ্যে দেখা গেছে, প্রতিবছর এনজিও খাতে ২০০ থেকে ২৪০ কোটি টাকা অনুদান দেয় দেশটি। তবে বাস্তবে এসব অনুদানের কতোটুকু সুবিধাভোগী হন দেশবাসী- তার কোনো সঠিক তথ্য নেই সরকারের কাছে।
অস্ট্রেলিয়ান স্বেচ্ছাসেবকরা ১১২টি ছোট ছোট প্রকল্পে দেশীয় ও বিদেশি এনজিও’র সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করেন।
এনজিওগুলো হলো, ওয়ার্ল্ড রিভিউ, ব্যাপ্টিস্ট এইড, ব্র্যাক, লাভ ফর ডিজাস্টার পিপল ফর বাংলাদেশ, হোপ-৮৭ বাংলাদেশ, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট, ঢাকা ইন্সটিটিউট ফর কালচার অ্যাফেয়ার্স, সিমবাইওসিস বাংলাদেশ, গ্রামীণ মৎস্য ফাউন্ডেশন, দ্য ফিড হ্যালো ফাউন্ডেশন, শপথ, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন, কন্যা, ট্রান্সফরম এইড ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ।
এছাড়া সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিচার্স বাংলাদেশ(সিআইপিআরবি), মহানগর, সেভ দ্য চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল, পারি ডেভেলপমেন্ট ট্রাস্ট, মুক্তি পরিষদ, এনজিও ফোরাম ফর পাবলিক হেলথ, নিজেরা শিখি, বিনা সংস্থা, বাংলাদেশ ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশন, সাতক্ষীরা উন্নয়ন সংস্থা, অ্যাকশন এইড, ডিপ আই কেয়ার ফাউন্ডেশন, আন্ডার প্রিভিলাইজড চিলড্রেন এডুকেশন, তইমু, পল্লী দরিদ্র কল্যাণ সংস্থা, ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট ফর সোশ্যাল অ্যান্ড হিউম্যান অ্যাফেয়ার্স, কো-অপারেশন ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশকে অনুদান দেয় দেশটি।
নারী উদ্যোগ কেন্দ্র, দ্য গ্লেনোই ফাউন্ডেশন, মানবিক, চাইল্ড সাইট ফাউন্ডেশন, ট্রাস্ট ফর রিহ্যাবিলিটেশন অব প্যারালাইজড, ফেথ ইন অ্যাকশন, ঢাকা আহসানিয়া মিশন, দক্ষিণ অঞ্চল দারিদ্র্য বিমোচন সংস্থা, চেতনা পরিষদ, মানব উন্নয়ন সংস্থা, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটি- এসব এনজিও সংস্থার সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার সম্পৃক্ততা আছে বলে জানায় এনজিও বিষয়ক ব্যুরো।
অন্যদিকে সমাজসেবা অধিদফতরে নিবন্ধিত হয়ে কাজ করে দেশ-বিদেশের স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থা। ১৫টি বিভিন্ন ধরনের সামাজিক কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য সংস্থাগুলোর নিবন্ধন হয়ে থাকে এখানে। কার্যক্রমগুলো হলো- শিশুকল্যাণ, যুবকল্যাণ, নারীকল্যাণ, শারীরিক ও মানসিকভাবে অসমর্থ ব্যক্তিদের কল্যাণ, পরিবার পরিকল্পনা, সমাজবিরোধী কার্যকলাপ থেকে জনগণকে বিরত রাখা, সামাজিক শিক্ষা, বয়স্কশিক্ষা, কারামুক্ত কয়েদিদের কল্যাণ ও পুনর্বাসন, কিশোর অপরাধীদের কল্যাণ, ভিক্ষুক ও দুস্থদের কল্যাণ, দরিদ্র রোগীদের কল্যাণ ও পুনর্বাসন, বৃদ্ধ ও দৈহিকভাবে অসমর্থ ব্যক্তিদের কল্যাণ, সমাজকল্যাণ কার্যক্রমে প্রশিক্ষণ এবং সমাজকল্যাণ সংস্থাগুলোর সমন্বয় সাধন। এসব কার্যক্রমের কোনোটিতেও নেই অস্ট্রেলিয়ান স্বেচ্ছাসেবীরা।
সমাজসেবা অধিদফতরের পরিচালক (কার্যক্রম) আবু মোহাম্মদ ইউসুফ বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের রেজিস্ট্রারের তালিকায় যেসব নাম রয়েছে তাতে অস্ট্রেলিয়ান কোনো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বা স্বেচ্ছাসেবকের নাম নেই। সহায়তার বিষয়ে তারা এগিয়ে এসেছে কি-না, তাও আমাদের মনে পড়ে না।
গত ৩০ নভেম্বর অস্ট্রেলিয়ার সিডনির পারামাত্তা এলাকায় অবস্থিত পুলিশ সদর দফতরের সামনে বন্দুকধারীদের গুলিতে দু’জন নিহত হন। নিজ দেশের এ পরিস্থিতির মধ্যেই আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে স্বেচ্ছাসেবকদের ফিরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া।
তবে বাংলাদেশ বলছে, সেদেশের তুলনায় বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক ভালো। অস্ট্রেলিয়ান স্বেচ্ছাসেবী চলে যাওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি ও পরিবেশ বাংলাদেশে কোনোদিনই তৈরি হয়নি।
অস্ট্রেলিয়ার স্বেচ্ছাসেবকদের চলে যাওয়া প্রসঙ্গে এনজিও বিষয়ক ব্যুরো’র পরিচালক (নিবন্ধন) কে এম আব্দুস সালাম বাংলানিউজকে বলেন, দেখুন, আজকে (০৩ ডিসেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুকধারীদের গুলিতে ১৪ জন নিহত হয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ায়ও এর আগে পুলিশ সদর দফতরের সামনে বন্দুকধারীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন দু’জন। সে তুলনায় আমাদের দেশের আইন-শৃঙ্খলা ও পরিবেশ অনেক ভালো। তবে এটা সঠিক যে, কোনো বিদেশি নাগরিক মারা গেলে একটা প্যানিক তৈরি হয়। সেটাও এখন আর নেই।
কতোজন অস্ট্রেলিয়ান স্বেচ্ছাসেবক বাংলাদেশে কাজ করেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্বপ্রণোদিতভাবে অস্ট্রেলিয়ান স্বেচ্ছাসেবীরা বাংলাদেশে এসে কাজ করে চলে যান। তাদের সঠিক তথ্য দেওয়া খুবই কঠিন।
বাংলাদেশ সময়: ০৬৪৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৬, ২০১৫
এমআইএস/এএসআর