ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে সরেজমিনে: কারাবন্দিদের সঙ্গে স্বজনদের সাক্ষাতের জন্য নির্দিষ্ট দিনে ও সময়ে কারাফটকের সামনের নির্ধারিত কাউন্টার থেকে টিকিট সংগ্রহ করতে হয়। ওই টিকিট দেখিয়েই পরে কয়েদি-হাজতিদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান স্বজনেরা।
দায়িত্বপ্রাপ্ত কারারক্ষীরা টাকার বিনিময়ে টিকিট বিক্রি করে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন সাক্ষাতের আশায় আসা স্বজনদের কাছ থেকে। তাইতো টাকায় টিকিট নয়, কারারক্ষীরা নিজেরাই বিক্রি হয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন ভুক্তভোগীরা।
গত মঙ্গলবার (০১ ডিসেম্বর) সরেজমিনে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান ফটকের সামনে গিয়ে এসব অভিযোগের সত্যতা মিলেছে।
কারাফটকের সামনে চকবাজারের দিকে কিছুটা গেলে কারাগারের দেয়ালের পূর্ব পাশের গলির ভেতরে ‘কারা ক্যান্টিন’। বেলা ১২টা ০৫ মিনিটে সেখানে অনেক নারী-পুরুষের সমাগম দেখা যায়। সবাই কারাগারের ভেতরে থাকা স্বজনদের সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে এসেছেন।
কারা ক্যান্টিনের পাশের ভবনের নিচতলার বারান্দায় টিকিট কাউন্টার। বারান্দার গ্রিলের দুই পাশে কার্টন (কাগজ) দিয়ে অর্ধেক ঢেকে করা হয়েছে কাউন্টারটি। সেখানে বসে টাকার বিনিময় টিকিট দিচ্ছেন দু্ই কারারক্ষী। বাইরে থেকে তাদের পুরো চেহারা দেখা যায় না।
কারারক্ষীদের পোশাকের সঙ্গে ‘নেমপ্লেট’ এর জায়গাটি খোলা। বাইরে থাকা দর্শনার্থীদের কাছ থেকে ২শ’ টাকা থেকে ৩শ’ টাকা নিয়ে টিকিট দিচ্ছিলেন তারা। ওই টিকিট কাউন্টারের লাইনে সাধারণ মানুষের সঙ্গে আরো দুইজন কারারক্ষী ঘোরাঘুরি করছিলেন। তাদেরও পোশাকেও নেমপ্লেট নেই।
কাউন্টারের কারারক্ষীদের ‘ভেতরে দেখা করার জন্য আনুষ্ঠানিকতা কি?’ বলে প্রশ্ন করা হলে কারারক্ষীরা উল্টো পরিচয় জানতে চান। তখন ‘বাংলানিউজ থেকে এসেছি’ বলার সঙ্গে সঙ্গে ওই স্থানে থাকা সকল কারারক্ষেই নড়েচড়ে বসতে শুরু করেন।
এ সময় এক কারারক্ষী প্রস্তাব দেন– ‘ভাই ভেতরে আসেন, কথা বলি’। কাউন্টারের ভেতরে যেতে সে কাউন্টার থেকে উঠে বাইরে আসলো।
এ সময় অন্য এক কারারক্ষী কাউন্টারের ওই কারারক্ষীকে বললেন- ‘সেলিম ভাই, কিছু একটা হয়েছে, এদিকে আসেন’। তখনই জানা গেলো, ওই কারারক্ষীর নাম সেলিম।
সেলিমকে প্রশ্ন করা হলো, ‘ভেতরে দেখা করার জন্য আপনারা কেন সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছেন? টাকা নেওয়ার তো কোনো নিয়ম নেই। তবে কেনো নিলেন’?
পরক্ষণেই মোটা অঙ্কের টাকা দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন ওই কারারক্ষী। কিছুক্ষণ জোরাজুরির পর কারাগারের বাইরে রক্ষীদের দায়িত্বে থাকা ইনচার্জ আওলাদকে মোবাইলে ঘটনাস্থলে ডেকে আনলেন।
ইনচার্জ আওলাদ ক্যান্টিনের পাশে এসে বললেন, ‘আমার সঙ্গে আসেন। সব কথা বলি’। পরে ক্যান্টিনের অপর পাশে নিয়ে গেলেন। কথা বলতে বলতে তিনিও মোটা অঙ্কের টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দেন। এক পর্যায়ে পকেটে টাকা গুঁজে দেওয়ারও চেষ্টা করেন।
আওলাদসহ ওই কাউন্টারে থাকা কারারক্ষীরা বলতে থাকেন- ‘ভাই আমরা গরিব মানুষ। এখানে অনেকেই আসেন। তাদেরকেও আমরা সেবা করে থাকি’।
এ সময় বাংলানিউজের ফটো করেসপন্ডেন্ট ছবি তুলতে গেলেও আওলাদ তাকেও বাধা দেন।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবিরের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। ডেপুটি জেলার নেসার আলমের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘কারাগারের ভেতরে থাকা আসামিদের সঙ্গে দেখা করার জন্য একটি ফরম পূরণ করতে হয়, কোনো টাকার প্রয়োজন হয় না।
বাংলানিউজের কাছ থেকে কারারক্ষীদের এমন অনিয়মের কথা শুনে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘এরকম অভিযোগ আমরা শুনিনি’।
বাংলানিউজকে ধন্যবাদ জানিয়ে ডেপুটি জেলার বলেন, ‘তবে আপনারা আমাকে জানিয়েছেন। আমি এর সঠিক ব্যবস্থা নেবো। আগামীকাল (বুধবার) থেকে অভিযুক্তদের ওইখানে আর ডিউটি করতে দেখবেন না’।
গত মঙ্গলবার রাত নয়টায় আবারও ডেপুটি জেলার নেসার আলমের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বাংলানিউজকে জানান, ‘ভাই নিউজটি করার কোনো দরকার নেই, ওইখানের দায়িত্বে যারা ছিলেন তাদের সবাইকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে’।
কারাফটকের সামনে স্বজনদের অপেক্ষা
কারাফটকের সামনে গিয়ে দেখা যায়, সকাল থেকেই সেখানে অনেকেই দাঁড়িয়ে আছেন, ভেতরে থাকা আসামিদের সাক্ষাতের অপেক্ষায়।
রাজধানীর লক্ষ্মীবাজার থেকে আসা দিপু চন্দ্র দাস বলেন, ‘আমার স্বজন বিরাম চন্দ্র দাস কারাগারের ভেতরে যমুনা-৩ এ আছেন’। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তিনি বলেন, ‘আসামি বিরামের তো আবার কোনো অসুবিধা হবে না?’
দিপু চন্দ্র দাস আরও বলেন, ‘ক্যান্টিনের পাশের ওই কাউন্টার থেকেই ২শ’ টাকা দিয়ে দেখা করার জন্য একটি টিকিট নেই। কারারক্ষীরাই এ টিকিট দিয়েছেন’।
দেখা করার জন্য বিনা পয়সায় কর্তৃপক্ষ টিকিট দিচ্ছেন, আপনি টাকা দিয়ে কেনো টিকিট কিনলেন? এ প্রশ্নের জবাবে দিপু বলেন, ‘বিনা পয়সার টিকিট নিয়ে কেউ আসামির সঙ্গে দেখা করেছেন কি-না তা আমার জানা নেই’।
সাক্ষাৎ শেষে বের হয়ে যাওয়ার সময় নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক স্বজন বাংলানিউজকে বলেন, ‘বাইরেও টাকা দিয়ে টিকিট কিনে ভেতরে প্রবেশ করে ওইখানের দায়িত্বরত কারারক্ষীকেও টাকা দিতে হয়েছে। আরে ভাই, কেন্দ্রীয় কারাগার হচ্ছে টাকার খেলা। টাকা দিলে এক ঘণ্টা পর দেখা হয়। আর ফ্রি টিকিট নিলে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা। তবুও ফ্রি টিকিটে সাক্ষাৎ হয় কি-না, তার নিশ্চয়তা নেই’।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৬, ২০১৫
এজেডএস/এসজেএ/এনএ/এএসআর