লালমনিরহাট: তিনজন সহযোদ্ধার খোঁজ পেলেই পাবেন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েও স্বীকৃত বঞ্চিত আবুল কাসেম (৬৮) তাই প্রতিবছর নোয়াখালী থেকে ছুটে আসেন উত্তরাঞ্চলের জেলা লালমনিরহাটে।
রোববার (৬ ডিসেম্বর) সকালে লালমনিরহাট মুক্ত দিবসে শোভাযাত্রায় অংশ নেন তিনি। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লালমনিরহাট জেলাকে হানাদার মুক্ত করতে অংশ নেন তিনি।
আবুল কাসেম নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি উপজেলার নাটেশ্বর গ্রামের মৃত আলী করিমের ছেলে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা তাকে সহযোগিতা করেছেন তাদের সঙ্গে কুশলাদি বিনিময়ের জন্যই দক্ষিণাঞ্চল থেকে প্রতি বছর ৬ ডিসেম্বর ছুটে আসেন লালমনিরহাটে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের টগবগে যুবক আবুল কাসেম আজ বয়সের ভারে ন্যূজ হয়েছেন ঠিকই তবে মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই সময়ের ভয়াল দিনগুলি স্মৃতি তেকে হারায়নি একটুও।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবুল কাসেম বাংলানিউজকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের আগেই ব্যবসার কাজে লালমনিরহাটের আদিতমারী গ্রামে মামা কাবিল মিয়ার বাড়িতে থাকতেন। দেশে যুদ্ধ শুরু হলে এপ্রিল মাসের কোনো একদিন আদিতমারী রেল স্টেশনে আবু তালেব নামে এক রাজাকার তাকে আটক করে বেঁধে রাখেন এবং পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে খবর পাঠান। এ সময় এক পথচারীর সহায়তায় পালিয়ে রক্ষা পান। ওই দিন তার মামার বাড়ির অধিকাংশ সদস্যকে পিস কমিটির লোকজন ধরে নিয়ে ক্যাম্পে জমা দেওয়ার খবর শুনে পালিয়ে চলে যান ভারতের কোচবিহার হয়ে দার্জিলিং শহরের মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ শিবিরে।
সেখানে একমাস প্রশিক্ষণ নেন তিনি। প্রশিক্ষণ শেষে ৬ নং সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপটেন দেলোয়ার হোসেনের অধীনে লালমনিরহাট জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন সেকশন কমান্ডার আবুল কাসেম।
আবুল কাসেম বলেন, ডিসেম্বরের শেষ দিকে রাজাকারদের সহায়তায় লালমনিরহাট সদরের বড়বাড়ি এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করে হানাদার বাহিনী। এ খবর শুনে ধরলা নদীর পাড় থেকে হানাদার বাহিনীর শিবিরে আক্রমণ করে মুক্তি বাহিনী। চলে তুমুল যুদ্ধ। এক পর্যায়ে পিছু হটে হানাদার বাহিনীর সদস্যরা।
কয়েক দিন পর পুনরায় বড়বাড়ি দখলে নেয় হানাদার বাহিনী। এতে আবারো আক্রমণ চালান তারা। এ যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর বুলেটের আঘাতে তার বাম পাশে থাকা সহযোদ্ধা বগুড়ার আব্দুল হক আর ডান পাশে শহীদ হন কয়েক জন সহযোদ্ধা। এ সময় একটি বড় আমগাছের আড়ালে আত্মরক্ষা করেন তিনি। আক্রমণে দিশেহারা হয়ে হানাদার বাহিনী ৬ ডিসেম্বর প্রথম প্রহরে তিস্তা রেল ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে লালমনিরহাট ছেড়ে পালিয়ে যায়। হানাদার মুক্ত হয় লালমনিরহাট জেলা।
তিনি বলেন, লালমনিরহাট জেলার মধ্যে বড়বাড়ি এলাকায় সব থেকে বেশি রাজাকার ছিল। হানাদার বাহিনী পালিয়ে গেলেও বড়বাড়ি এলাকায় ওই দিন শতাধিক রাজাকার অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করে। তখন তিনি সেকশন কমান্ডার হিসেবে সব অস্ত্র গরুর গাড়িতে করে নিয়ে যান মুক্তিবাহিনীর শিবিরে।
দেশ স্বাধীন হলে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একটি ভবনে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক আতাউল গনি ওসমানির স্বাক্ষরিত একটি সনদ নিয়ে নোয়াখালীতে ফিরে আসেন আবুল কাসেম। বাড়ি গিয়ে দেখতে পান হানাদার বাহিনী তার বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে।
জীবনের তাগিদেই স্বল্প শিক্ষিত আবুল কাসেম চাকরি নেন একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে। সেখানে ইনক্রিমেন্ট পাওয়ার আশায় মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্রটি জমা দেন। পরবর্তীতে আর খোঁজ মেলেনি সেই সনদের। ফলে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাননি তিনি।
সেই স্বীকৃতি পেতে বর্তমানে তার প্রয়োজন তিন জন সহযোদ্ধার। এ সহযোদ্ধার খোঁজে প্রতি বছর ৬ ডিসেম্বর লালমনিরহাটে ছুটে আসেন। মুক্তদিবসের কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে স্মৃতিচারণ করেই চলেছেন কিন্তু খোঁজ মেলেনি সহযোদ্ধার।
আবুল কাসেম বলেন, সহযোদ্ধা পেলে সরকারের কাছে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির জন্য আবেদন করতে পারতাম। তবে যাই হোক সহযোদ্ধা না পাই দুঃখ নেই, জীবন বাজি রেখে যে অঞ্চল হানাদার মুক্ত করেছি, সে অঞ্চলের মাটি মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়ে শোভাযাত্রায় অংশ নিতে পেরেছি, এটাই তো অনেক।
লালমনিরহাটের বড়বাড়ি এলাকার যুদ্ধে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা জুলহাস উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, আবুল কাসেমের সঙ্গে কথা বলে মনে হচ্ছে তিনি সত্যিই ওই সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।
লালমনিরহাট জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা মেজবাহ উদ্দিন আহম্মেদ বাংলানিউজকে বলেন, আবুল কাসেমের সঙ্গে কথা বলে মনে হচ্ছে তিনি বড়বাড়ির সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ সময়: ২৩৩৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৬, ২০১৫
এমজেড/এসএইচ