নোয়াখালী: সাত ডিসেম্বর। নোয়াখালী মুক্ত দিবস।
ডিসেম্বরের এ দিনটি স্মরণে নোয়াখালীর পিটিআই’র সামনে একটি মুক্ত মঞ্চ নির্মাণ করা হয়।
মুক্ত দিবস উপলক্ষে সোমবার (০৭ ডিসেম্বর) দিনব্যাপী জেলা প্রশাসন, জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড ইউনিট ও মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা পরিষদের উদ্যোগে মুক্ত মঞ্চে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, আলোচনাসভা, স্মৃতিচারণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বিজয় র্যালির আয়োজন করা হয়েছে।
ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, একাত্তরের ২৫ মার্চ কালো রাত্রিতে পাক হানাদার বাহিনী ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞের উদ্দেশে নিরস্ত্র বাঙালির উপর ঝাপিয়ে পড়ে।
সেই দিন গভীর রাতে ঢাকা থেকে নোয়াখালী জেলা প্রশাসক মনজরুল করিম, বঙ্গবন্ধুর প্রথমসারির সহচর আবদুল মালেক উকিল ও তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তানের রিপোর্টার কামাল উদ্দিন আহমেদের কাছে গোপনে মেসেজ আসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন।
এর পরপরই নোয়াখালী টাউন হল হয়ে উঠে বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের কন্ট্রোল রুম। ২২ এপ্রিল পর্যন্ত নোয়াখালী ছিল শত্রু মুক্ত। পরে ২৬ এপ্রিল কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি শক্তিশালী দল নোয়াখালীতে প্রবেশ করে মাইজদি পিটিআইতে ঘাঁটি স্থাপন করে। তৈরি করে টর্চার সেল। জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে তারা মুক্তিকামী মানুষদের ধরে এনে নির্যাতন চালাতো।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক জেলা ইউনিট কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা এ বি এম ফজুলল হক বাদল সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বাংলানিউজকে জানান, ৬ ডিসেম্বর ফেনী ও লক্ষ্মীপুরসহ তৎকালীন বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল শত্রুমুক্ত হতে থাকে। এরমধ্যে সাত ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী যৌথভাবে নোয়াখালী জেলা শহর ঘিরে ফেলে।
নোয়াখালী জেলা বিএলএফ কমান্ডার মাহমদুর রহমান বেলায়েতের নির্দেশে প্রত্যেকটি থানা কমান্ডারদের নির্দেশ দেন প্রত্যেক থানা সদর দপ্তর আক্রমণ করে পুরোপুরি শত্রু মুক্ত করতে। জেলা শহরের পিটিআই দখলের দায়িত্ব পড়ে সদরের সব মুক্তিযোদ্ধাদের উপর।
ওই দিনের যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা ফজলে এলাহী, মমিন উল্লাহ, মিজানুর রহমান, ফজলুল হক বাদল, মোজাম্মেল হক মিলন, জিএস কাশেম, রফিক উল্লা কমান্ডার, মাইন উদ্দিন জাহাঙ্গীর, মোহাম্মদ উল্যাহ, মোশারফ হোসেন, ভিপি জয়নাল আবেদীন, আবুল কাশেম ব্যাংকার, আলী কারী করিম উল্যাহ, কামাল উদ্দিন আহাম্মদ চেয়ারম্যান, জয়নাল আবেদীন চেয়ারম্যান, লেদু মিয়া চেয়ারম্যান, সফিকুর রহমান, মোস্তফা কামাল, আজিজুর রহমান ইকবাল, মমতাজুল করিম বাচ্চু ও মিয়া মোহাম্মদ শাহজাহানসহ সব বাহিনীর কয়েক শত মুক্তিযোদ্ধা জেলা শহরের রাজাকার আল বদরের ক্যাম্প নাহার মঞ্জিল, মাইজদীকোর্ট রেলস্টেশন, হরিনারায়ণপুর, দত্তেরহাট রাজাকার ক্যাম্প ও পাক হানাদার বাহিনীর প্রধান ঘাঁটি পিটিআই’র হোস্টেল ভবনে আক্রমণ চালায়।
পিটিআই আক্রমণ করতে এসে মুক্তিযোদ্ধারা শহরের প্রবেশ পথে নাহার বিল্ডিং রাজাকার ক্যাম্প, মাইজদী কোর্ট স্টেশন রাজাকার ক্যাম্প, দত্তের হাট রাজাকার ক্যাম্প উড়িয়ে দেয়। তারা জেলা জামে মসজিদের পশ্চিমে অবস্থিত রেনু মিয়া কন্টাক্টরের বাড়ি থেকে বর্তমান নতুন বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে। জেলার উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব অঞ্চল থেকে সব মুক্তিযোদ্ধা শহরে এসে বাকি তিন দিক ঘিরে ফেলে।
পিটিআই এলাকাটি সংরক্ষিত এলাকা। পাক বাহিনী রাতের অন্ধকারে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের জবাব দেয় ৩০৩ রাইফেল দিয়ে। এদিকে ফেনী ২নম্বর সেক্টর কমান্ডার কর্নেল জাফর ইমাম মাইজদী পিটিআই যুদ্ধের খবর পেয়ে তার একটি সেকশন নিয়ে দুপুরে এসে মাইজদী অবস্থান নেন। মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান এবং শত্রু’র অবস্থান জেনে শক্রর আস্তানায় দুটি দুই ইঞ্চি মোটর সেল নিক্ষেপ করলে সঙ্গে সঙ্গে রাজাকাররা ব্রাশফায়ার শুরু করে।
ওই সময় কয়েকজন রাজাকার নিহত হয় এবং অনেকে পালিয়ে যায়। শত্রুপক্ষের গুলিতে শহীদ হয়েছেন নোয়াখালী কলেজের অধ্যাপক আবুল হাসেম, ছাত্র নজরুল ইসলাম স্বপন, সরকারি কর্মকর্তা আবদুল জলিল, নাজির বসু মিয়া ও একজন অজ্ঞাতপরিচয় আনসার সদস্য।
সাত ডিসেম্বর বিকেল পর্যন্ত একটানা ৪৮ ঘণ্টা যুদ্ধের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
একই সময় সুবেদার লুৎফুর রহমানের নেতৃত্বে সুবেদার শামছুল হক সহ মুক্তিযোদ্ধারা বেগমগঞ্জে টেকনিক্যাল হাই স্কুল সহ বিভিন্ন ক্যাম্পের শত্রুদের পরাজিত করে বিজয় পতাকা উড়িয়ে দেয়। শত্রুমুক্ত হয় নোয়াখালী।
সেই দিন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে স্বাধীনতার বিজয় পতাকা হাতে নিয়ে হাজারো মুক্তিকামী মানুষ জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে বিজয় উল্লাসে মেতে উঠে জেলা শহর মাইজদীতে।
তাই সাত ডিসেম্বর নোয়াখালী মুক্ত দিবস স্মরণে পিটিআই ভবনের প্রধান গেটের সামনে ‘মুক্ত নোয়াখালী’ নাম দিয়ে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়।
পিটিআই গেটে মুক্ত নোয়াখালী নামে যে সৌধটি দাঁড়িয়ে আছে এটি সাত ডিসেম্বর নোয়াখালী মুক্ত হওয়ার স্বাক্ষর বহন করে। নোয়াখালী মুক্ত দিবস হোক মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমৃদ্ধ ভবিষ্যত প্রজন্মের প্রেরণার উৎস। এটাই এখানকার মুক্তিকামী জনগণের প্রত্যাশা।
বাংলাদেশ সময়: ০৫২১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৭, ২০১৫
একে/এসএইচ