ঢাকা: ‘স্যার আমার রোদেলা কেমন আছে? জ্ঞান ফিরছে কি? কখন সুস্থ হবে? আমি কখন দেখতে পাবো?’
নিবিড় পরিচর্চা কেন্দ্র থেকে বের হলে চিকিৎসকের প্রতি এমন সব প্রশ্ন ছিলো মা হালিমা বেগমের।
এক বছর এক মাসের শিশু রোদেলার ছোট্ট হার্টে সার্জারি হয়েছে।
সেখানে শুধু রোদেলা একা নয়, গত পাঁচ দিনে (০৫ থেকে ০৯ ডিসেম্বর) বিনামূল্যে এমন ২৪ শিশুর কার্ডিয়াক অপারেশন (বুক কেটে) হয়েছে। এছাড়া একই সময়ে করা হয়েছে আরও ৩৫ শিশুর কার্ডিয়াক ইন্টারভেনশন (বুক না কেটে)।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এসব অপারেশন সফল ও সবাই সুস্থ রয়েছে।
সরেজমিনে বৃহস্পতিবার (১০ ডিসেম্বর) সিএমএইচ কার্ডিয়াক সেন্টারের নিবিড় পরিচর্চা কেন্দ্রে দেখা যায়, দু’টি কক্ষের বিভিন্ন বিছানায় শুয়ে রয়েছে চিকিৎসাধীন শিশুরা। দেশি-বিদেশি সেবিকারা সারাক্ষণ তাদের পরিচর্চা করছেন। চিকিৎসকরা কিছু সময় পর পর পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছেন।
এসময় শিশুদের চিকিৎসা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জানান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. একেএম মুসা খান।
তিনি আইসিইউ থেকে বের হয়ে এলে গেটে দৌড়ে আসেন রোদেলার মা হালিমা।
হালিমার প্রশ্নের জবাবে ডা. মুসা খান বলেন, এখন পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক। সময়ে সময়ে আপনাদের অগ্রগতি জানিয়ে দেওয়া হবে। প্রয়োজন হলে আপনাদের ডাকবো।
সৌদি আরবের শিশু হৃদরোগের চিকিৎসকদের পরিচালিত ‘লিটল হার্ট’ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সিএমএইচ’র শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদের যৌথ উদ্যোগে দেশের সুবিধাবঞ্চিত এসব শিশুদের চিকিৎসা চলছে। লন্ডনভিত্তিক সাহায্য সংস্থা ‘মুনতাদা এইড’ এতে অর্থায়ন করছে।
মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলা থেকে আসা রোদেলার মা হালিমা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, জন্মের পর থেকেই রোদেলা শরীরে নানা সমস্যায় দেখা দেয়। কিছুদিন পর পর ওর ঠাণ্ডা লেগে যেতো। প্রাথমিক চিকিৎসায় কোনো কাজ না হওয়ায় একবার ওকে খুলনা মেডিকেলে নিয়ে যাই। এরপর সেখানকার চিকিৎসকরা জানান, রোদেলা হৃদরোগে আক্রান্ত।
তিনি বলেন, এরপর রোদেলার চিকিৎসার জন্য ঢাকায় একটি হাসপাতলে ভর্তি করানো হয়। পরে সেখানকার এক চিকিৎসক সিএমএইচ-এ বিনামূল্যে হার্টের সার্জারির কথা জানান। এরপর এখানেই ভর্তি করা হয়েছে।
ময়মনসিংহের তিন বছরের শিশু হৃদানকে অপারেশন থিয়েটারে দিয়ে মা কামরুন্নাহার রীতা কার্ডিয়াক সেন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ সময় তিনি বলেন, জন্মের পর থেকেই হৃদান বেশি কান্নাকাটি করতো। গায়ে ঘন ঘন জ্বর আসতো। এরপর একদিন ময়মনসিংহ হাসপাতালে নিয়ে যাই। চিকিৎসকরা জানান, হৃদান হৃদরোগে আক্রান্ত।
তিনি বলেন, এরপর রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে নিয়ে আসা হলে সেখাকার এক চিকিৎসক সিএমএইচ’র কথা বলেন। গত ০৬ ডিসেম্বর হৃদানকে এখানে ভর্তি করা হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন, ও এখন সুস্থ রয়েছে।
এখানে ঢাকা জেলার নয়হাটির শিশু শ্রাবন্তী পালের (৯) ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছে।
শ্রাবন্তীর মা সবিতা পাল বলেন, জন্মের পর শ্রাবন্তীর নিউমোনিয়া হয়। এরপর থেকে ওর ঠাণ্ডার সমস্যাও দেখা দেয়। আট বছর আগে ওকে ঢাকা শিশু হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেইসময় ডাক্তারা জানিয়ে দেন, শ্রাবন্তী হৃদরোগে আক্রান্ত।
শ্রাবন্তীর বাবা রুপার অলঙ্কার তৈরির কারিগর নিত্য পাল বলেন, ডাক্তাররা বলেছিলেন ওর চিকিৎসার জন্য পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা প্রয়োজন। কিন্তু অর্থের জোগাড় করতে না পেরে সেসময় আর অপারেশন করা হয়নি।
সিএমএইচ এ বিনামূল্যে হার্টের অপারেশন হচ্ছে জেনে সেখানে যোগাযোগ করেন শ্রাবন্তীর মা-বাবা। এরপর এখানে শ্রাবন্তীর চিকিৎসা চলছে।
চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার নয় বছরের আরেক শিশু প্রেমা শীলের ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছে এখানে।
প্রেমার মা সেবীকা শীল বলেন, প্রেমা জন্মের পর থেকেই অসুস্থ। গায়ে জ্বর থাকতো, ওজন বাড়ছিলো না। এরপর চট্টগ্রামে বহু ডাক্তার দেখিয়েছি। গত আট বছর ধরে চিকিৎসা করিয়েছি। কিন্তু কোনো অগ্রগতি হয়নি।
প্রেমার বাবা প্রদীপ শীল সেলুনে কাজ করেন জানিয়ে মা সেবীকা বলেন, এতোদিন টাকার অভাবে প্রেমার অপারেশন করাতে পারিনি। এখন এখানে ফ্রি চিকিৎসা হচ্ছে।
চিকিৎসকরা জানান, গত ০৫ ডিসেম্বর থেকে সিএমএইচ-এ এ চিকিৎসা শুরু হয়েছে। বিনামূল্যে এ সেবা চলবে শনিবার (১২ ডিসেম্বর) পর্যন্ত।
সৌদি আরবের ‘লিটল হার্ট’র পক্ষে ২৪ জন সদস্য এ মিশনে এসেছেন। এতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ডা. জামিল আব্দুল আজিজ-আল-আতা। তিনি এ মিশনে ইন্টারভেনশন কার্ডিওলজিস্ট হিসেবে রয়েছেন। এছাড়া কার্ডিয়াক সার্জন হিসেবে রয়েছে ডা. মোহাম্মদ সিহাতা।
মিশনের উদ্দেশ্য, বাংলাদেশের দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের হৃদরোগী শিশুদের সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া।
এর আগে, গত বছরের অক্টোবর ও চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চে দুইবারে ১শ ২৩ জন হৃদরোগী শিশুর সফল ওপেন হার্ট সার্জারি ও ইন্টারভেনশন করা হয়।
সিএমএইচ থেকে এই দলে রয়েছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. একেএম মুসা খান ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. নূরুন নাহার ফাতেমা।
ডা. মুসা খান বলেন, দেশে প্রতি হাজারে ২০ জন শিশু হৃদরোগ নিয়ে জন্ম নেয়। এসব রোগের সার্জারি করতে সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা ব্যয় হয়। ‘লিটন হার্ট’ এসব চিকিৎসা আমাদের দেশে বিনামূল্যে করছে। এজন্য তাদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।
ভবিষতেও তারা আমাদের দেশের শিশুদের এ চিকিৎসা সেবার ধারা অব্যাহত রাখবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, শিশুদের হৃদরোগের বিষয়ে সবার মধ্যে সচেতনতা দরকার। আমরাও সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে শিশুদের এসব সার্জারি ও ইন্টারভেনশন করে থাকি।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০১৫
টিএইচ/এসএস