কক্সবাজার: স্বাধীনতার ৪৪ বছর কেটে গেছে। কিন্তু সংরক্ষণ হয়নি কক্সবাজারের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন, বধ্যভূমি, গণকবরসহ নানা স্থাপনা।
এছাড়া কালের পরিবর্তনে অধিকাংশই হয়ে গেছে বেদখল। কয়েকটি বধ্যভূমির স্মৃতিচিহ্নও নেই। এরপরও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতার ইতিহাস মুছে যায়নি কক্সবাজারবাসীর মন থেকে।
দীর্ঘদিন ধরেই এখানকার মানুষ বধ্যভূমি সংরক্ষণে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সূত্র জানায়, কক্সবাজার জেলার তিনটি উপজেলায় ১২টি স্থানকে বধ্যভূমি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে কক্সবাজার পৌরসভার কবিতা চত্বর সড়কের ১৬ ইসিবির দপ্তর সংলগ্ন ছয় একর জমি।
মহেশখালীতে ১০টি ও টেকনাফে একটি বধ্যভূমি চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে এসবের একটিকেও সংরক্ষণ করা হয়নি। উল্টো বেদখল হয়ে গেছে আটটি বধ্যভূমি, চারটি অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া ইতিহাসের পাতা থেকে এসব স্মৃতিচিহ্ন মুছে দিতে চলছে নানা ষড়যন্ত্র।
কক্সবাজার জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রমজান আলী বাহাদুর জানান, ১৯৭১ সালের ১২ মে কক্সবাজার শহরে কবিতা চত্বর রোডে পুরোনো সিভিল রেস্ট হাউসে (১৬ ইসিবি দপ্তর) পাকিস্তানি বাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে। এরপর থেকেই সেখানে চলে ধর্ষণ, নির্যাতন, আর খুন।
প্রতিদিন রাত পোহালেই দেখা যেতো শেয়াল-কুকুর অসংখ্য নারী পুরুষের মরদেহ নিয়ে টানাটানি করছে।
তিনি আরো জানান, স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও শহরের বধ্যভূমির ছয় একর জায়গা এখনো মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি।
এ ব্যাপারে বধ্যভূমি চিহ্নিত কমিটির অন্যতম সদস্য প্রবীণ আইনজীবী অ্যাডভোকেট হাবিবুর রহমান জানান, ১৯৯৭ সালে শহরের বধ্যভূমিটি চিহ্নিত করা হয়। ইসিবি ক্যাম্পের পশ্চিম ও উত্তর পাশের ছয় একর জমিকে। সে সময় বধ্যভূমিকে চিহ্নিত করে চারপাশে বাঁশের বেড়া দেওয়া হয়। কিন্তু ক্ষমতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বেদখল হয়ে গেছে সেই বধ্যভূমি।
কক্সবাজার জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার মোহাম্মদ শাহজাহান জানান, ওই বধ্যভূমিতে কমপক্ষে দুই হাজার নারী পুরুষকে হত্যা করা হয়েছিল। নির্যাতনের শিকার হয়েছিল অগণিত তরুণী। একটি মহল মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্নকে ধ্বংস করার জন্য সেখানে গড়ে তুলেছে বাহারছড়া উচ্চ বিদ্যালয়, ইসলামিয়া মহিলা কামিল মাদ্রাসা, মসজিদ, এতিমখানা ও বসতবাড়িসহ নানা স্থাপনা।
মুক্তিযোদ্ধা আমির হামজা জানান, ১৭ ইসিবি ক্যাম্প স্থাপনের আগে এখানে মানুষের মাথার খুলি ও হাড়ের সন্ধান মিলেছে। আস্তে আস্তে দখল হয়ে যাচ্ছে বধ্যভূমিটি। এর ওপর নির্মিত হয়েছে মাদ্রাসা ও বসতবাড়ি। কিন্তু এখানকার পাতকূয়াটি তাদের কাছে মৃত্যুকূপ হিসেবে পরিচিত। তবে এটিও সংরক্ষণের অভাবে ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে।
সরেজমিনে বধ্যভূমি এলাকা পরিদর্শন করে দেখা যায়, বধ্যভূমির পশ্চিমপাশে বাহারছড়া উচ্চ বিদ্যালয়, এর পেছনে শ’দুয়েক রোহিঙ্গা পরিবারের বসতি, এর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছড়ার পাশে বাউন্ডারি দিয়ে ঘেরা ইসলামিয়া মহিলা কামিল মাদ্রাসা। এর ভেতরে রয়েছে তিন তলা তিনটি ভবন। যেসব নির্মাণ বিএনপি- জামায়াত জোট সরকারের আমল থেকে। এর পাশে রয়েছে একটি মসজিদ। এরপর দাল্লাল এতিম কমপ্লেক্স নামে একটি তিন তলা ভবন। ওই ভবনের সামনে দিয়ে ১৬ ইসিবি দপ্তর ও বিমান বাহিনীর ঘাঁটি। বিমান বাহিনীর ঘাঁটির পেছনে রয়েছে ওই পাতকূয়া দু’টি। তবে ময়লা আবর্জনায় ভরাট হয়ে গেছে।
এ বিষয়ে ইসলামিয়া মহিলা কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ জাফর নূরী জানান, বধ্যভূমি মাদ্রাসার জায়গায় নয়। বধ্যভূমিটি বাহারছড়া স্কুল ও তার আশপাশের মানুষের বসতবাড়িতে অবস্থিত।
কিন্তু বিজয় স্মারক গ্রন্থে কক্সবাজার বধ্যভূমি নামক প্রবন্ধের লেখক সাংবাদিক ফজলুল কাদের চৌধুরী জানান, বধ্যভূমির জমিতে গড়ে উঠেছে ওই মাদ্রাসা ভবনসহ এতিমখানা।
এছাড়া মহেশখালী উপজেলার ১০টি বধ্যভূমির মধ্যে ছয়টি বধ্যভূমি বেদখল হয়ে গেছে। বাকি চারটি অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে গোরকঘাটা বাজার ও দক্ষিণ হিন্দু পাড়া, ঠাকুরতলা আদিনাথ পাহাড়, হোয়ানক পুইছড়ি, মুন্সির ডেইল, কালারমারছড়া বাজার এলাকার বধ্যভূমি দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে দোকানপাট ও বসতঘর।
একই উপজেলায় অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে বড় মহেশখালী দেবেঙ্গাপাড়া, দেবেঙ্গাপাড়া শ্মশান, পালপাড়া ও কায়স্থপাড়া এলাকার বধ্যভূমি।
এছাড়া টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পেছনে নাইটং পাহাড়ের পাদদেশে একটি বধ্যভূমি অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। এ বধ্যভূমির জমিতে বসতবাড়ি গড়ে উঠেছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আনোয়ারুল নাসের জানান, ৯ ডিসেম্বর বধ্যভূমি সংরক্ষণের বিষয়ে জেলা প্রশাসন সম্মেলন কক্ষে একটি বৈঠক করা হয়। ওই বৈঠকে ১৬ ইসিবি সংলগ্ন বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। শিগগিরই এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১১২৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০১৫
আরএ