ফেনী: ভয়াল সেদিনের কথা মনে হলে আজো আঁতকে উঠি। বোমার সে শব্দ এখনও স্পষ্ট।
মুক্তিযুদ্ধকালীন ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলার মুন্সীরহাটের জামমুড়া গ্রামে হানাদারের আর্টিলারি হামলায় তার পরিবারের ২৭ জনসহ মোট ৩১ জন শহীদ হয়েছিলেন। ওই দিন কাচারি ঘরে রাত যাপন করায় বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি।
বর্তমানে তার বয়স ৭০। ঘটনার সময় তার বয়স ছিল ২৫ বছর। তিনি সেদিনের শহীদ অলি আহমদের ছেলে।
করিমুল হক বাংলানিউজকে বলেন, দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ১৭ জুন। সারাদেশে চলছে তুমুল যুদ্ধ, জেলার পরশুরাম উপজেলার বিলোনীয়া সীমান্ত দিয়ে চলছিল মুক্তি বাহিনী আর হানাদার বাহিনীর পাল্টা-পাল্টি আক্রমণ।
তার দাদা আনা মিয়া চারদিন আগে মারা যান, সেদিন ছিল কুলখানি। এ কুলখানিকে কেন্দ্র করে দূর-দূরান্ত থেকে আত্মীয় স্বজন আসেন তাদের বাড়িতে। এশার নামাজের পর যথারীতি সবাই খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়েন। এর কিছুক্ষণ পর শোনা যায় বোমার বিকট শব্দ, সঙ্গে সঙ্গে উড়ে যায় দু’টি ঘর। শহীদ হন ৩১টি তাজা প্রাণ, কারো হাত নেই, কারো পা, কারো বা আবার দেহ থেকে মাথা আলাদা।
করিমুল হক বলেন, ভাগ্যিস সেদিন বাড়ির বাইরে ছিলাম তাই বেঁচে গিয়েছিলাম, না হয় আমার অবস্থাও অন্যদের মতোই হতো।
গ্রামের বাসিন্দা ষাটোর্ধ শামছুল আলম চৌধুরী জানান, কুলখানি উপলক্ষে ওই বাড়িতে অনেক মেহমান ছিল। বাড়ির পাশেই ছিল উত্তর জামমুড়া স্কুল। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাসহ চার শতাধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনী গভীর রাতে ওই স্কুলটিকে লক্ষ্য করে তিনটি বোমা ছোড়ে। বোমাগুলো গিয়ে পড়ে আনা মিয়ার টিনশেড ঘরের চালায়। সঙ্গে সঙ্গে ৩১ জন অঙ্গার হয়ে যায়। পরে তাদের কবর দেওয়া হয়, যা এখন জামমুড়া গণকবর।
গ্রামের আরেক বাসিন্দা সলিম উল্লাহ জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ১৪ বছর। সেদিনের কথা আজো তার স্পষ্ট মনে পড়ে। ক্ষত-বিক্ষত মরদেহগুলো নিয়ে বাঁশের খাছিতে (এক ধরনের পাত্র) করে ছয়টি কবরে শায়িত করা হয়েছিল।
সেদিনের কথা মনে হলে ভয়ে এখনো বুকটা কেঁপে ওঠে তার। তিনি বলেন, বেশির ভাগ মরদেহ ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তারা কয়েকজন গ্রামবাসী সেগুলোকে বাইরে বের করে আনেন। এরপর কোনোমতে গোসল দিয়ে বাড়ি থেকে কয়েকশ’ গজ পশ্চিমে আনা মিয়ার মালিকানাধীন একটি জমিতে দাফন করেন।
সেদিনের শহীদ অলি আহম্মদের নাতনি তানিয়া তাবাচ্ছুম ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, মুক্তিযুদ্ধে তার পরিবারের অনেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, নষ্ট হয়েছে সম্পত্তি কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ৪৪ বছর পেরিয়ে গেলেও শহীদ পরিবার হিসেবে আজো তারা পাননি সে সম্মান, আর রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনো সুযোগ সুবিধা। সহায় সম্পদ হারিয়ে বিরান হওয়া পরিবারগুলোর প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ায়নি কেউ। এমনকি সরকারিভাবে সংরক্ষণও করা হয়নি তাদের গণকবর।
অথচ এ গণকবরে শুয়ে আছেন মুক্তিযুদ্ধের সময় নিহত ৩১ জন শহীদ। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও তাদের খোঁজ রাখেনি দেশের সরকার। শহীদদের স্মরণে নির্মিত হয়নি কোনো স্মৃতিসৌধ। স্বাধীনতা বা বিজয় দিবসে কেউ তাদের কবরে ফুল দেয় না, জানায় না শ্রদ্ধাঞ্জলি।
শহীদ অলি আহম্মদের ছেলে সফিকুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, মুক্তিযুকালীন জামমুড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা হাজী আনা মিয়ার বাড়িতে অসংখ্য শরণার্থী আশ্রয় নেয়। মে মাসের শেষের দিকে অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল জাফর ইমামের নেতৃত্বে ওই এলাকায় টানা ১৭ দিন যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ৭০ জন পাকসেনা নিহত হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ জুন হাজী আনা মিয়ার বাড়ির পুকুর পাড় থেকে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর ঘাঁটি লক্ষ্য করে আর্টিলারি হামলা চালায়। এর পরের দিন ১৭ জুন রাতে পাক হানাদার বাহিনী পাল্টা হামলা চালালে আনা মিয়ার বাড়িতে আর্টিলারি শেল পড়ে। এতে একই পরিবারের ২৭ জন সদস্যসহ মোট ৩১ জন শহীদ হন।
জামমুড়া গণকবরের পাঁচটি অংশের মধ্যে একটি অংশে পাকা দেয়ালের বেষ্টনী দিয়ে সমাধি ফলক তৈরি করেছে স্বজনরা। প্রতিবছর ১৭ জুন আনা মিয়ার বাড়ির সদস্য ছাড়াও এলাকার লোকজন এ গণকবরে ব্যক্তিগত উদ্যোগে দোয়া মোনাজাত করলেও সরকারিভাবে নেওয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক সাবেক ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য ভিপি জয়নাল বাংলানিউউজকে জানান, যুদ্ধের সময় এ পরিবারের ওপর যে হামলা করা হয়েছিল তা গণহত্যাগুলোর অন্যতম। যুদ্ধের এত বছর পার হলেও শহীদ পরিবার ও গণকবর রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণ না হওয়া দুঃখজনক।
ফেনী জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মীর আবদুল হান্নান জানান, তিনিও বিষয়টি জানেন তবে কেন গণকবর এবং শহীদ পরিবার তাদের যথাযথ সম্মান পায়নি সে ব্যাপারে কিছু বলতে পারেননি। তিনি জানান, বিস্তারিত খোঁজ খবর নিয়ে এ ব্যাপারে নিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এলাকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শহীদদের স্মৃতিধন্য জামমুড়া এলাকাটি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার এলাকা হওয়া স্বত্ত্বেও অবহেলিত রয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ-বিএনপি কোনো সরকারই এ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে পারেনি।
সেদিন যারা শহীদ হয়েছিলেন:
আত্মীয় স্বজন ও এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে সেদিনের শহীদদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের নাম পাওয়া যায়, তাদের মধ্যে অলি আহম্মদ (৫০), তার স্ত্রী ফজিলাতুন্নেসা, মেয়ে হাফসা বেগম (১২), রিনা (৮) ছেলে মহসিন (৭), অহিদুল্লাহ (৬), রেজাউল করিম (৩), বন্দুয়া হাসানপুরের শামছুন নাহার (২৫), কমুয়ার শরফা খাতুন (৫৫), তার ছেলে মনসুর (১২), ছাগলনাইয়ার দেবপুর গ্রামের অন্তঃস্বত্ত্বা সেতারা বেগম (২০) পারুল আক্তার (১৮), মনোয়ারা বেগম (২০), তার মেয়ে এনি (৫), ছেলে লক্ষ্মী (২), কমুয়ার কবির আহম্মদ (১৮), মোনায়ারা বেগম (২০), পারুল আক্তার (১৮), অন্তঃস্বত্ত্বা ফাতেমা খাতুন (২৫), তার মেয়ে রাবেয়া (৩), ছালেহ আহম্মদ (৬), ছেমনার মেয়ে (২) প্রমুখ।
বাংলাদেশ সময়: ১১৫৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০১৫
আরএ