ধুনট (বগুড়া): একাত্তরে রণাঙ্গণে পাক হানাদারদের সঙ্গে একাধিক সম্মুখযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন আব্দুস ছাত্তার। নয় মাসে হারিয়েছেন অনেক সহযোদ্ধা।
পাকিস্তানি হায়েনাদের বিরুদ্ধে জয়ী হয়েছেন অকুতোভয় এ বীর। তবে জীবনযুদ্ধে জয়ী হতে পারেননি তিনি। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নিরাপদ দেশ তৈরির এ কারিগরের নিজেরই মেলেনি একটুকরো জমি।
ফলে গত ৪৪ বছরে পরিবার-পরিজন নিয়ে অন্যের বাড়িতে আশ্রিত হিসেবে বসবাস করে আসছেন সহায়-সম্বলহীন আব্দুস ছাত্তার। ৬ সদস্যের পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য ফুটপাতে দোকান দিয়ে চা বিক্রি করেন এ মুক্তিযোদ্ধা।
আব্দুস ছাত্তারের বাড়ি বগুড়ার ধুনট উপজেলার গোসাইবাড়ি গ্রামে। বাবার নাম আব্দুল আজিজ। পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে এক ছেলে ও এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বর্তমানে স্ত্রী, চার ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তার নিত্য টানোপোড়েনের সংসার।
সরেজমিনে গোসাইবাড়ি সাতমাথা এলাকায় আব্দুস সাত্তারের চায়ের দোকানে গিয়ে দেখা যায় জীর্ন একটি টিনশেড দোকান। সেখানে বসে কথা হয় তার সঙ্গে।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে আব্দুস ছাত্তার জানান, মায়ের কোলে থাকতেই তার বাবা মারা যান। অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে ছোট বেলা থেকে বড় হয়েছেন। সঙ্গতি না থাকায় পড়াশোনাও হয়নি বেশিদূর। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন।
তরুণ বয়সেই জীবিকার সন্ধানে বের হন। গ্রামে গ্রামে দিনমজুর খেটে জীবন চলা শুরু হয় তার। তখন ২০ বছরের টগবগে যুবক তিনি। এরই মধ্যে দেশে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।
বাড়ির অদূরেই যমুনা নদীর শহড়াবাড়ি ঘাট। একদিন পড়ন্ত বিকেলে বেড়াতে যান সেই ঘাটে। তীরে দাঁড়িয়ে দেখেন এলাকার দামাল ছেলেরা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে নৌপথে ভারতের দিকে পাড়ি জমাচ্ছেন। আগ-পিছ না ভেবে উঠে বসেন তাদের সঙ্গে নৌকায়। চার দিন পর ভারতের মানকার চর এলাকার কাকড়িপাড়া গ্রামে পৌঁছান তারা। সেখানে দুই সপ্তাহ যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। এরপর অদক্ষ হাতে অস্ত্র নিয়ে বের হয় দেশ-মাতৃকার মুক্তির শপথ নিয়ে।
বুড়িমারি সীমান্ত এলাকার তুষভান্ডার ক্যাম্পে অন্যান্য যোদ্ধার সঙ্গে অবস্থান করেন তিনি। সেখান থেকে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিদিন যুদ্ধ হতো তাদের।
আব্দুস সাত্তার জানান, তার সেক্টর নম্বর-৬ এবং মুক্তিবার্তা নম্বর ১১৮/০৪। দিনক্ষণ মনে নেই। একদিন যুদ্ধ করতে গিয়ে শত্রুর বুলেট বাম হাতের কবজিতে বিদ্ধ হয়। কয়েক দিন চিকিৎসা নিয়ে আবারোও ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে।
তিনি জানান, দেশ স্বাধীনের তিন মাস পর ফিরে আসেন বাড়ি। এর একমাস পর বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। একসময় জীবিকার সন্ধানে পাড়ি জমান রাজধানী ঢাকায়। সেখানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি শুরু করেন।
এদিকে বাড়তে থাকে পরিবারের সদস্য সংখ্যা। পরিবার চালানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। তাই কিছুদিন পর বাড়ি ফিরে আবারো শুরু করেন দিনমজুরি।
কিন্ত একসময় শরীরে আগের মতো আর শক্তি পান না। ভেবে-চিন্তে চায়ের দোকান করার সিদ্ধান্ত নেন। জায়গার অভাবে রাস্তার পাশে ফুটপাতে ছোট একটি ছাপড়া ঘর তুলে সেখানেই দোকান দিয়ে বসেন।
তিনি জানান, বর্তমানে চা বিক্রি করে দৈনিক ২০০ টাকার মতো আয় হয়। এছাড়া মাসিক মুক্তিযোদ্ধা ভাতার টাকা পান। এসব দিয়ে কোনোরকমে চলছে সংসার।
না পাওয়া কিংবা দরিদ্রতা নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই হতদরিদ্র আব্দুস ছাত্তারের। শুধু নিজের এক টুকরো জায়গা বা বসতভিটা নেই বলে কখনো কখনো আক্ষেপ হয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধের এ বীর সেনানীর ইচ্ছা মৃত্যুর পর নিজের এক টুকরো জমিতে চিরনিদ্রায় শায়িত হবার।
বাংলাদেশ সময়: ২০৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০১৫
এসআর