খুলনার ডুমুরিয়ার চুকনগর বধ্যভূমি থেকে ফিরে: স্বাধীনতার ৪৪ বছর হয়ে গেলো। দীর্ঘ এই সময়ে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে হয়েছে অনেক গবেষণা।
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগর হত্যাকাণ্ডের অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী চুকনগর গণহত্যা ১৯৭১ স্মৃতিরক্ষা পরিষদের সভাপতি ও চুকনগর কলেজের অধ্যক্ষ শফিকুল ইসলাম ক্ষোভ আর আক্ষেপের সাথে বাংলানিউজের কাছে এসব কথা বলেন।
তিনি জানান, স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৪৪ বছর পার হলেও এখানকার বধ্যভূমিতে স্মৃতিসৌধ ও পূর্ণাঙ্গ একটি কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ১৫ খণ্ডের দলিলের পাতায় আজো লেখা হয়নি চুকনগর গণহত্যার ইতিহাস। স্বীকৃতিও দেওয়া হয়নি শহীদদের সন্তানদের। এসব পরিবারের এখন দিন কাটছে আনাহারে-অর্ধাহারে।
২০০৯ সাল থেকে বধ্যভূমি সংরক্ষণে পাঁচ দফা দাবি জানিয়ে আসছি। দাবিগুলো হচ্ছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ১৫ খণ্ডের দলিলে চুকনগর গণহত্যার ইতিহাস যথাযথভাবে উল্লেখ করা, বধ্যভূমিতে জাদুঘর, লাইব্রেরি, কমপ্লেক্স নির্মাণসহ এখানে পর্যটন এলাকা গড়ে তোলা ও কেয়ারটেকার নিয়োগ, ২০ মে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনে সরকারি ঘোষণা এবং চুকনগর বাজার থেকে বধ্যভূমি পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার পাকা সড়ক নির্মাণ। কিন্তু সে দাবি কেউ বাস্তবায়ন করেনি। ২০০৫ সালে মাত্র সাত লাখ টাকা ব্যয়ে চুকনগর বধ্যভূমিতে একটি সৌধ নির্মাণ করা হলেও এটা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য স্থায়ীভাবে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি বলেও জানান অধ্যক্ষ শফিকুল ইসলাম।
আক্ষেপ করে তিনি বলেন, মুখে মুখে অনেকে স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের চেতনার কথা বললেও সত্যিকার দেশপ্রেমিকের সংখ্যা খুবই কম। যে কারণে আজও চুকনগর রয়েছে অবহেলিত।
স্মৃতিরক্ষা পরিষদের সভাপতি আরও জানান, বধ্যভূমিতে একজন অস্থায়ী কেয়ারটেকার আছে। তার পক্ষে সামান্য বেতনে কিছুই করা সম্ভব না। নিজ খরচেই পতাকা কিনে চুকনগর বধ্যভূমির সৌধে লাগিয়ে আসছি। এছাড়া ২০ মে চুকনগর গণহত্যা দিবসের আয়োজনও অনেকটা তার ব্যক্তিগত খরচে হয়ে থাকে বলেও জানান তিনি।
চুকনগরের বধ্যভূমির পাশের মালতিয়া গ্রামের বাসিন্দা সরকারি বিএল কলেজের ছাত্র মেহেদী হাসান বাংলানিউজকে বলেন, অরক্ষিত এ বধ্যভূমিতে দিনরাত বখাটেদের আড্ডা চলে। অনেকেই এখানে বিড়ি, সিগারেট, গাঁজা খেতে আসে। কেউ কেউ আসে প্রেম করতে।
সোহেল নামের ডুমুরিয়া কলেজের এক ছাত্র বলেন, দিনের বেলা এখানে গোচারণভূমি ও রাতে মাদকসেবীদের নিরাপদ আড্ডাস্থলে পরিণত হয়ে আছে।
বৃহস্পতিবার (১০ ডিসেম্বর) সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে চুকনগর বধ্যভূমি অরক্ষিত হয়ে আছে। একটি স্মৃতিস্তম্ভ আছে। কিন্তু কোথাও নামফলক কিংবা সাইনবোর্ড নেই। একটি গেট থাকলেও তা খোলা রয়েছে। যার কারণে যে কেউ ইচ্ছামতো জুতা পড়ে স্মৃতিস্তম্ভের উপর চলাচল করছে।
চুকনগর বধ্যভূমির কেয়ারটেকার ফজলুর রহমান মোড়ল বাংলানিউজকে বলেন, মাত্র দুই হাজার টাকা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া হয় আমাকে। আমি চেষ্টা করি বধ্যভূমি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আর পবিত্র রাখার জন্য। কিন্তু সব সময় সম্ভব হয় না।
তিনি জানান, চীন-জাপানসহ বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা এ বধ্যভূমি দেখতে আসেন। কোনো নামফলক না থাকায় তারা প্রথমে এটা চিনতে পারেন না। স্থানীয়দের মাধ্যমেই তাদের তথ্য নিতে হয়।
উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলার সময় ৫ মে দক্ষিণাঞ্চলে বাংলাদেশের সর্ব প্রথম রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। এই রাজাকার বাহিনীর নেতৃত্ব দেন তৎকালীন জামায়াত নেতা এ কে এম ইউসুফ। রাজাকার বাহিনী গঠিত হওয়ার পর প্রত্যন্ত অঞ্চলে সাধারণ মানুষের ওপর শুরু হয় অমানুষিক নির্যাতন। এই নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতে গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, বাগেরহাট, খুলনা, বটিয়াঘাটা, দাকোপ, ফুলতলাসহ বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার হাজার হাজার মানুষ ভারতে যাওয়ার উদ্দেশে আশ্রয় নেয় ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগর এলাকায়। ২০ মে সকাল ১০টার দিকে খাবার খেয়ে চুকনগর বাজার, ভদ্রা নদী, মালতিয়া গ্রামের পাতখোলার মাঠে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন এসব মানুষ। তাদের উদ্দেশ্য দুপুরের দিকে কেশবপুর দিয়ে সীমান্ত পার হয়ে ভারতের দিকে রওনা হবেন।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সাতক্ষীরা থেকে পাকিস্তান বাহিনীর ২টি গাড়ি আসে চুকনগর বাজারের পাতখোলার মাঠে। হানাদাররা সেখানে জড়ো হওয়া হাজার হাজার নারী-পুরুষকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। জমিতে কাজ করা অবস্থায় মালতিয়া গ্রামের অধিবাসী কৃষক চিকন আলীকে সর্ব প্রথম গুলি করে হত্যা করা হয়। পাকিস্তানি সেনাদের এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের পর ১০ হাজারের অধিক নারী-পুরুষের লাশ এখানে-সেখানে পড়ে থাকে।
বাংলাদেশ সময়: ০১২৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৫
এমআরএম/এমজেএফ