ডিগ্রীচর গ্রাম, সিরাজগঞ্জ থেকে ফিরে: প্রতিদিন ২২৫ টাকা মজুরি। তাই বিদ্যালয়ে হাজিরা দিয়েই ফসলের ক্ষেতে চলে এসেছে ওরা।
মাত্র ৭/৮ বছর বয়সেই শুরু হয়ে গেছে মানিক, বকুল, রাব্বি, শরীফ ও কাইয়ুমদের কর্মজীবন। অভাবের তাড়নায় অস্বচ্ছল পরিবারই ওদের ঠেলে দিচ্ছে শিশুশ্রমে। বয়সে কোমলতি হলেও এখনই নামের পাশে জুটেছে শিশুশ্রমিকের তকমা। এতে করে চরমভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে শিশুশ্রম আইন।
আইনত ওদের শ্রমিক হওয়া নিষিদ্ধ হলেও এমন চিত্রই দেখা গেছে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার ডিগ্রীচর গ্রামে। রোববার (১৭ জানুয়ারি) দুপুরে এ গ্রামের ফসলের ক্ষেতগুলোতে শৈশবের অধিকার বঞ্চিত এসব শিশুর শ্রমিক হয়ে ওঠার গল্পও শোনা গেলো তাদের মুখেই।
ডিগ্রীচর গ্রামেই থাকেন মানিক হোসেন। বয়স ১২ এর কাছাকাছি। জন্মের পরপরই হারিয়েছেন বাবা-মাকে। বড় ভাই-বোনের সঙ্গেই থাকেন। অভাব-অনটনে জর্জরিত পরিবারের এই ক্ষুদ্র সদস্যকে এ বয়সেই নামতে হয়েছে উপার্জনের ধান্ধায়।
বোরো মৌসুম শুরু হওয়ায় গ্রামের অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থের ক্ষেতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিরামহীন কাজ করতে হয় তাকে। মানিক স্থানীয় ছইদাবাদ হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র।
রোববার (১৭ জানুয়ারি) দুপুরে যখন তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল তখন তার বয়সী আরো অনেক শিশুর সঙ্গে স্থানীয় সোহরাব মিয়ার ক্ষেতে বোরো ধানের চারা রোপন করছিল সে।
স্কুল ফাঁকি দিয়ে মাঠে কেন, জানতে চাইলে হাসছিল মানিক। কিছুক্ষণ নীরব থেকে উত্তর দেয়, আমরার তো অভাব। কাম কইরা ভাত খাই। স্কুলে এক বেইল (একটা ক্লাস) কইরা ক্ষেতে লাইগ্যা গেছি।
কথা শেষ না হতেই গুণগুণ করে গান গেয়ে ওঠে মানিক, ‘আমার গাঁয়ে যতো দুঃখ সয়....। ’ মানিকের গানে কণ্ঠ মেলায় রাব্বি, কাইয়ুমরাও।
অভাবের বৃত্তে বন্দি পরিবারেই বেড়ে ওঠা বকুলের। বাবা জামাত আলীও শ্রমিক। কাজের সন্ধানে গেছেন উপজেলা সদরে। ৬ সদস্যের বড় পরিবার। নুন আন্তে পান্তা ফুরায় অবস্থা। বকুলের পড়াশুনার খরচ চালানোরও সামর্থ্য নেই বাবার। নতুন বছরে স্থানীয় ওই বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে সপ্তম শ্রেণীতে উঠেছে সে।
এখন পর্যন্ত কেনা হয়নি স্কুল ড্রেস, খাতা-কলম। চলতি বোরো মৌসুমে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গতরে খেটে ২২৫ টাকা মজুরি পাবে। আর এ টাকা জমা করেই পড়াশুনার যাবতীয় উপকরণ কিনবে তারা।
কৃষিকাজের নাম লেখানো আরেক শিশুশ্রমিক শরীফ আহমেদ জানায়, আর মাত্র ১৫ দিন। এরপর জালা গাড়ার কাজ শেষ হবে। প্রতিদিন টাকা জমিয়ে স্কুলের ড্রেস, খাতা-কলম কিনবে সে। বাকি টাকা বাবার হাতে তুলে দেবে। না হলে তো পড়ালেখাও হবে না, সংসারও চলবে না।
দেশের শ্রম আইন অনুযায়ী, ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সব ছেলে-মেয়েই শিশু। এ বয়স পর্যন্ত তাদের শ্রমে নিযুক্ত করা আইনত নিষিদ্ধ। ২০০৬ সালের শ্রম আইনের ৪০, ৪১ ও ৪৪ ধারায় এসব বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু তাদের বাবা-মা থেকে শুরু করে যারা কাজ দিচ্ছেন কেউ মানছেন না এ শ্রম আইন।
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার স্থানীয় খিদীর, পঞ্চসারটিয়া, পোড়াবাড়িসহ বিভিন্ন গ্রামে বোরো মৌসুমে দেখা মিললো মানিক, শরীফ, কাইয়ুমদের মতো কর্মজীবী অনেক শিশুর। বই-পুস্তক নিয়ে এরা স্কুলে ছুটে গেলেও পেটের দায়ে আবার স্কুলে নামমাত্র হাজিরা দিয়ে ফিরতে হয় মাঠে। এ যেন ভবিষ্যৎ কৃষকের কৃষিক্ষেত্রে সহজ পাঠ।
৭/৮ বছর বয়সী এসব শিশুর স্বপ্ন অবশ্য কৃষক হওয়া নয়। বড় হয়ে ওরা সরকারি চাকরি করতে চায়। মানিক, শরীফরা জানায়, নিজেদের এ স্বপ্ন পূরণের জন্যই সংসারে চরম অস্বচ্ছলতা থাকার পরেও যতোটুকু পারছে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে ওরা। কিন্তু ওরাও জানে, এ স্বপ্নের নাগাল যোজন যোজন দূরে।
বাংলাদেশ সময় ০৮১০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০১৬
আরএম