নিঝুম দ্বীপ (হাতিয়া) থেকে: পাড় ভাঙার শব্দ ঘরে শুয়েই শোনা যায় স্পষ্ট। ভাটার টান আর জোয়ারের কলকল ধ্বনিও পরিষ্কার ভেসে আসে কানে।
তবুও ভয়-ডরহীন চিত্তে ৪/৫ জন বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে নিঝুম দ্বীপের শেষ প্রান্তে বাস করছেন জমিলা বেগম, তার ছোট বোন রাহেলা বেগম, জমিলার স্বামী সালাহউদ্দিন, রাহেলার স্বামী ইসমাইল হোসেন, জমিলা-রাহেলার বাবা সিলামাত হোসেন।
সোমবার (১৮ জানুয়ারি) নিঝুম দ্বীপের সমুদ্র সৈকত ঘুরে বন্দরটিলায় ফেরার পথে জমিলা-রাহেলার পর্ণকুটির চোখে পড়ে। শুকনো খেজুর ডাঁটা, পাটের ছেঁড়া বস্তা, পলিথিন আর কলা গাছের শুকনো ডগা দিয়ে ঘেরা টিনের ছাউনিওয়ালা ঘরটিতে প্রবেশের সুযোগ মিলল অনুমতি সাপেক্ষে।
সামান্য বাতাসে শোঁ-শোঁ শব্দে দুলতে থাকা জমিলা বেগমের ঘরের সামনে দাঁড়াতেই ৮ বছর বয়সী ছেলে আব্দুর রহিম দুই দুইটি মোড়া নিয়ে হাজির। অভ্যাগত দুই সংবাদকর্মীকে অভ্যর্থনা জানাতে চেষ্টার কমিতে নেই তার। বোধ করি মা জমিলা বেগম চোখ বা হাতের ইশারায় অতিথিদের জন্য মোড়া আনার নির্দেশ দিয়েছিল তাকে।
ঘরের বাইরে না বসে ভেতরটা ঘুরে দেখার অনুমতি প্রার্থনা করতেই ৯ সদস্য’র ঘরটির তিন প্রকোষ্ঠেই নিয়ে গেলেন জমিলা বেগম। এত ছোট একটি ঘরে ৯ জনের বসবাস হলেও মোটা-মুটি পরিপাটি।
বাবা-স্বামী ও বোন জামাইয়ের পেশা সম্পর্কে জানতে চাইলে জমিলা বেগম বলেন, আব্বার বয়স হয়েছে। তাই এখন তেমন কিছু করেন না। বাথানের কাজ (অন্যের গরু-মহিষের চরানো) করেন।
আর আমার উনি (স্বামী) ও ছোট বোনের স্বামী নদীতে মাছ ধরেন। বড় নৌকার কাজ না পাওয়ায় সাগরে যেতে পারেন না, নদীতেই ইলিশ ও অন্যান্য মাছ ধরেন উনারা দুইজন মিলে।
সাগরের এত কাছে এমন একটা ঘরে থাকতে ভয় করে না? -ভয় তো করেই। কিন্তু শক্ত মাটিতে তো আমাদের জায়গা-জমি নাই। তাই এখানে থাকি। বান (ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, সাইক্লোন) সবাইকে নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যাই-বলেন রাহেলা বেগম।
কিছুক্ষণের আলাপে আরো জানা যায়- জমিলা-রাহেলা বেগমের ক্ষুদ্র জীবনে বালুচরে বাঁধা ঘর অসংখ্যবার সরাতে হয়েছে। গত ২০ বছরে এই নিঝুম দ্বীপে অন্তত ৮ বার বাসস্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে তাদের। কিন্তু এ নিয়ে তাদের কোনো খেদ নেই।
জমিলা বেগমের সাথে কথা বলতে বলতে ঘরে এসে হাজির হন বাবা সিলামাত হোসেন। তিনিও তার স্মৃতির পাতা উল্টে বহু ভাঙা গড়ার ইতিহাস শোনান। নদী-ভাঙন, নদীতে ভেসে মাছ ধরা, আর ৩০ বছর আগে হাতিয়া থেকে এসে নিঝুম দ্বীপে আস্তানা গাঁড়ার গল্প অল্প অল্প করে উঠে আসে তারা স্মৃতিচারণে।
জমিলা বেগমের মনে কোনো খেদ না থাকলেও ষাটোর্ধ্ব সিলামাত হোসেনের মনের কোণে জমে আছে কিছু হতাশা ও না পাওয়ার যন্ত্রণা।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ৩০ বছর ধরে এই দ্বীপে বসবাস করলেও আমাদের নামে কোনো জমি বন্দবস্ত দেওয়া হয়নি। আমরা কেবল ধাক্কা খেয়ে এপাড় থেকে ওপাড়ে যাই, ওপাড় থেকে এপাড়ে আসি। আর বারবার খাস জমি বন্দবস্ত হয় বড়লোকের নামে।
শুধু সিলামত হোসেনের দুই মেয়ে জমিলা ও রাহেলা বেগমের ঘর নয়, নিঝুম দ্বীপ ঘুরে এ রকম অসংখ্য জমিলা-রাহেলা বেগমের খবর পাওয়া যাবে, যারা গত ৩০ বছরে অন্তত ৮/১০ বার তাদের পর্ণকুটির একস্থান থেকে আরেক স্থানে সরিয়েছে।
নিঝুম দ্বীপ আসার আগে স্পিড বোট থেকে দ্বীপ হাতিয়ার নলচিরা ও তমরউদ্দিন ঘাটের আশপাশে এ রকম অসংখ্য ঝুপড়ি ঘর চোখে পড়েছে। সেখানকার বাসিন্দারা ঘরে শুয়েই নদী ভাঙনের শব্দ অথবা সমুদ্রের নিদারুণ গর্জন শুনতে পায়। তবুও তারা ঘর বাঁধে ওই বেদনার বালুচরে।
বাংলাদেশ সময়: ১২২৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০১৬
এজেড/জেডএম
** ‘শ্রম কিনাঙ্ক কঠিন যাদের নির্দয় মুঠি তলে’
** ‘মগু অ্যাটা হটু তোলেন’
** ঘাসিয়ার চরে মানুষের বসত
** ‘জানালার কাছে ডেকে গেছে এক পাখির মতন সকাল’