হাতিয়া, নিঝুম দ্বীপ থেকে ফিরে: ঘটনাটা প্রথম ঘটে ১৭ জানুয়ারি রোববার। ওই দিন দুপুর দেড়টায় হাতিয়ার নলচিরা ঘাট থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ঘাসিয়ার চরে যাওয়ার জন্য স্পিডবোটে ওঠার চেষ্টা করছিলাম আমরা ১১ জন।
আমি ছাড়া বাকি ১০ জন আমার মতোই সংবাদকর্মী। সবাই গেছেন ঢাকা থেকে। প্রত্যেকের পরনেই প্যান্ট, ট্রাউজার অথবা থ্রি-কোয়ার্টার। পায়ে কেডস্, জুতা অথবা স্লিপার।
ভাটার টানে নলচিরা ঘাট থেকে মেঘনা নদীর পানি অনেকটা নিচে নেমে যাওয়ায় প্যান্ট, ট্রাউজার, থ্রি-কোয়ার্টার, কেডস, জুতা ও স্লিপার পরা শহুরে মানুষগুলোকে বিপাকে পড়তে হলো।
কারো সাহায্য ছাড়া হেঁটে স্পিডবোটে উঠতে গেলে নিশ্চিতভাবে হাঁটুর ওপরের অংশ পর্যন্ত নরম কাদায় ডুবে যাবে। হাল্কা স্পিডবোটে কাঠের পাটাতন দিয়ে লোক তোলারও কোনো সুযোগ নেই।
উপায়ন্ত না দেখে আমরা সবাই প্যান্ট-ট্রাউজার মুড়িয়ে হাটুর উপরে তোলার চেষ্টা করছি। কেউ কেউ পায়ের জুতা, কেডস ও স্লিপার খুলে কাদায় নেমে পড়েছেন স্পিডবোটে ওঠার জন্য।
এমন সময় কোথা থেকে দুই সুঠাম দেহের মাঝবয়সী লোক দৌড়ে এসে প্রথমে আমাদের কাঁধে থাকা ব্যাগ তুলে নিলেন নিজেদের কাঁধে। পরে আমাদের একেকজনকে ছোট বাচ্চার মতো তুলে নিলেন কোলে!
কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আলতো করে স্পিডবোটের ওপর নিয়ে নামিয়ে দিলেন। আচমকা ঘটে যাওয়া এ ঘটনায় আমরা সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বড় ধরনের দুর্ঘটনায় পতিত হওয়া ছাড়া পূর্ণবয়স্ক কোনো পুরুষের জীবনে সাধারণত এ ধরনের অভিজ্ঞতা হয় না।
কেন দৌড়ে ছুটে এসে অচেনা-অনাত্মীয় মানুষগুলোকে কোলে করে স্পিডবোটে তুলে দিতে গেলেন মো. জব্বার হোসেন ও মোকসেদ আলী।
কোনো ভূমিকা ছাড়াই তাদের সরল উত্তর- ‘আমনেরা আছছেন ফূর্তি করনের লাই। যুদি লোধের ভেতরে পড়েন, আমনেগো আনন্দ মাটি হইয়া যাইব’ (আপনারা এসেছেন আনন্দ করার জন্য। যদি কাদার মধ্যে পড়েন, আপনাদের আনন্দ মাটি হয়ে যাবে)।
ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, নদী ভাঙন, সুপেয় পানির অভাব, গ্যাস-বিদ্যুৎ-বিনোদনহীন নিরানন্দ যাদের জীবন, সেই তারাই কিনা শহর থেকে যাওয়া ১১ জন যুবকের ভ্রমণ আনন্দকে মাটি হতে দিতে চান না। কোনো ধরনের বিনিময় ছাড়াই ব্যাগ-পেট্টা তো বটেই পুরো মানুষটাকেই কোলে তুলে নিলেন। নিরাপদে উঠিয়ে দিলেন স্পিডবোটে।
নলচিরা থেকে ৩০ মিনিটের যাত্রা শেষে দুপুর ২টার দিকে ঘাসিয়ার চরে পৌঁছালে ওখানে বাস্তবায়নাধীন আশ্রয়ণ প্রকল্পে কর্মরত দুই যুবক আবারও আমাদেরকে কোলে করে স্পিডবোট থেকে নামানোর উদ্যোগ নিচ্ছিলেন। কিন্তু এবার আমরা আগে থেকেই পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম, কাদা যতই হোক, কারো কোলে চড়ে নামবো না। সুতরাং কোনো সুযোগ না দিয়েই যার যার মতো লফিয়ে পড়লাম কাদার মধ্যে।
পরে অবশ্য ঘাসিয়ার চরে গিয়ে শ্রমজীবী ওই পরম বন্ধুদের সহযোগিতায়ই আবদ্ধ একটি জলাধারে নেমে পায়ের কাদা পরিস্কার করতে হল আমাদের।
ঘাসিয়ার চর থেকে বিকেল সাড়ে ৪টায় যখন নিঝুম দ্বীপের উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছিলাম, তখন আমাদের স্পিডবোট অনেক দূরে। কারণ, ভাটার টানে পানি নেমে গেছে। তাই স্পিডবোট ঘাসিয়ার চরের সরু খাল থেকে একেবারে নদীতে নিয়ে রাখা হয়েছে।
প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে রাখা ওই স্পিডবোটে আমাদের যাতে হেঁটে যেতে না হয়, সেজন্য নিজেদের কাজ ফেলে একটি ডাম্পারে (মাটি টানার জন্য ছোট ট্রাক) করে পৌঁছে দিয়ে এলেন আমাদের। আর পড়ন্ত বিকেলে ঘাসিয়ার চরের মহিষের দুধের গরম চা দিয়ে আপ্যায়ন- সেটাও কেবল মহৎপ্রাণ মানুষের পক্ষেই সম্ভব বৈকি।
ঘটনাটি দ্বিতীবারের মতো ঘটে ১৯ জানুয়ারি সোমবার। সেদিন আমরা হরিণ দেখার জন্য সিডিএসপি বাজার থেকে ট্রলারে উঠছিলাম। এদিনও ভাটার টানে তীর থেকে নদীর পানি অনেকটা নিচে নেমে যাওয়ায় দুই মহৎপ্রাণ মানুষের কোলে চড়ে ট্রলারে উঠতে হয়েছিল।
ঘটনাটি দ্বিতীয়বারের মতো ঘটায় আমরা খুব একটা বেশি আশ্চর্য হইনি। কিন্তু মনের মধ্যে প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেয়েছি আমরা সবাই। শহর থেকে যাওয়া মানুষগুলোকে বিনা পয়সায় ও পারিশ্রমিকে যেভাবে তারা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, তাদের জন্য শহুরে মানুষগুলো কি এতোটুকু করতে পারবেন?
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০১৬
এজেড/এএসআর