ঢাকা: স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে, চারপাশে অবিরাম রঙের মেলা, জয়ে দর্শকদের বাঁধভাঙা উল্লাস কিংবা পরাজয়ের বেদনায় অশ্রুপাতের নিত্যকাব্য আমাদের সবারই কম-বেশি জানা।
অন্তরালে একইরকম কান্না-হাসির গল্প রয়েছে স্টেডিয়ামের নিজেরও।
খোলা চোখে স্টেডিয়ামের গ্যালারির কান্না আমরা কেউ না দেখলেও, না শুনলেও থেমে নেই স্টেডিয়ামের গ্যালারির কান্না!
গভীর মনে চোখ মেললেই, কি কান পাতলে এখন হরহামেশাই দেখা যাবে একসময়ের দর্শকঠাসা বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের গ্যালারির অশ্রুপাত, শোনা যাবে মাতমধ্বনি!
কখন কাঁদে একটি গ্যালারি! হাজারো দর্শকের উপস্থিতির কথা মাথায় রেখে তৈরি করা গ্যালারিতে যখন দর্শকরা এসে বসেন না, জাতীয় ম্যাচগুলোর পাশাপাশি দিনের পর দিন আন্তর্জাতিক এক-একটি ম্যাচেও যখন গ্যালারিগুলো দর্শকদের সরব উপস্থিতির স্পর্শ পায়না তখনই কেবল চোখ ফেটে জল আসে গ্যালারির।
মুখ ফিরিয়ে নেওয়া দর্শকদের উদ্দেশে তখন অনবরত তার উদাত্ত আহ্বান, ‘তোমরা এসো, বসো আর আমাকে পূর্ণ করো!’ কিন্তু সে মিনতি এখন আর টানে না দেশের মানুষকে, দর্শককে। মোটকথা ফুটবলের দর্শককে।
দর্শকের জন্য উদগ্রীব, কান্নারত এমন গ্যালারির দেখা মেলে এখন অপেক্ষায় অবিরত কান্নায় ভেঙে পড়া এমন গ্যালারিগুলোর দেখা মিলবে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে গেলে। যেন অনাদি-অনন্তকাল ধরে দর্শকখরায় নিস্তেজ হয়ে পড়েছে গ্যালারিগুলো।
অতীতের ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের এই দর্শকখরা চোখে পড়লো বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের এবারের আসরেও। গেলো ৮ জানুয়ারি শুরু হওয়া এই আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্টের গ্রুপ পর্বের প্রথম চারটি ম্যাচ যশোরের শামস-উল-হুদা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হওয়ার পর ১৩ জানুয়ারি থেকে শুরু হয় ঢাকাপর্ব।
যশোরে দর্শক সমাগম মোটামুটি হলেও হতাশ হতে হয়েছে ঢাকার দর্শকদের ব্যাপারে। গ্রুপ পর্বের শুরু থেকে একেবারে সেমিফাইনাল পর্যন্ত স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বলতে গেলে দর্শকশূন্যতা ছিল চোখে পড়ার মতো।
প্রথম সেমিফাইনালে বাংলাদেশ-বাহরাইনের মধ্যকার ম্যাচে সামান্য দর্শক দেখা গেলেও দ্বিতীয় সেমিফাইনালে নেপাল ও মালদ্বীপের মধ্যকার ম্যাচে ২৪ হাজার ৬শ দর্শক ধারণক্ষতার স্টেডিয়ামে দর্শক উপস্থিতি ছিল মাত্র ৫৬ জন! যা রীতিমতো লজ্জাজনক।
একসময় ফুটবল ছিল এদেশের মানুষের প্রাণের খেলা। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের ফুটবলের রয়েছে স্বর্ণালী অতীত। গৌরবও কম নয়। এমনকি, নিকট অতীত ২০০৩ সালের সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরবসহ আছে আরও অনেক বীরত্বগাঁথা।
তুবও দিন-দিন কমে যাচ্ছে দর্শক। দর্শকখরায় পড়ে কেন অহর্নিশ স্টেডিয়ামের গ্যালারিগুলোর এমন কান্না? খোঁজ নিয়ে মিললো অনেক প্রশ্নের উত্তর।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিকেএসপির ফুটবলের হেড কোচ উজ্জ্বল চক্রবর্তী শিবু বাংলানিউজকে বললেন, দিন-দিন আমাদের জাতীয় দলের জয়ের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক এক-একটি ম্যাচে অনেক আশা করে মাঠে গিয়েও দর্শকরা যখন দেখেন নিজেদের জাতীয় দল হেরে যাচ্ছে তখন তারা হতাশ হয়ে ঘরে ফেরেন। ফলে সংগত কারণেই মাঠে গিয়ে খেলা দেখার আগ্রহ বোধ করেন না।
দর্শকদের মাঠে গিয়ে খেলা না দেখার পেছনের কারণ আরও দেখছেন এই কোচ। বললেন, ‘এ প্রজন্মের দর্শকরা অনেক সচেতন। আকাশ সংস্কৃতির কারণে এখন তারা ঘরে বসে স্যাটেলাইট টিভিতে ইউরোপিয়ান লিগের খেলা দেখতে পারছেন। এই খেলা দেখার পর আমাদের জাতীয় দলের খেলা দেখার কোনো ইচ্ছাই তাদের থাকে না! কারণ, ইউরোপিয়ান লিগের খেলার মান আর আমাদের খেলার মানের দুস্তর ব্যবধানটা দর্শকরা খুব সহেজেই ধরে ফেলেন। মেসি, রোনালদো ও নেইমারের মতো কাঁপন ধরানো বিশ্বসেরা ফুটবলারদের খেলা দেখার পর আমাদের খেলা ভালো না লাগাটাই স্বাভাবিক’।
ঢাকার মাঠে দর্শকশূন্যতার অবশ্য আরও একটি বড় কারণ দেখালেন শিবু।
‘আপনি দেখে থাকবেন আমাদের বিভাগীয় বা জেলা স্টেডিয়ামগুলোতে আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজন করা হলে সেখানে দর্শকদের উপচে পরা ভিড় থাকে। এর কারণ হলো, সেখানকার ম্যাচগুলো দেখতে যেতে দর্শকদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকতে হয় না। কোনো প্রকার যানজট ছাড়াই তারা ম্যাচগুলো দেখতে পারেন যা ঢাকাতে সম্ভব হয় না। ধরেন, আমার বাসা মিরপুর। এখান থেকে আমি বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখার কথা ভাবলেই পথের যানজটের কথা চিন্তা করেই আমি ক্লান্ত হয়ে যাই। তারপরেও গেলাম না হয়। কিন্তু স্টেডিয়ামে যাওয়ার পর যখন আমার দল হারবে তখন আমার কষ্টের মাত্রা বেড়ে যাবে। এত কষ্ট করে মাঠে আসাটার কোন মানেই থাকবে না। হ্যাঁ, যদি আমার দল জিততো তাহলে এই কষ্টটা কষ্ট মনে হতো না’।
এমন ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট অতিক্রম করেই তো ক্রিকেট দেখতে মাঠে দর্শকদের উপচে পড়া ভিড় থাকে। সেইসঙ্গে গ্যালারি উপচে পড়ে দর্শকে। এটা কেন হয়?
এর উত্তরে বিকেএসপির এই কোচ জানালেন, ‘প্রথমত ক্রিকেটে আমাদের দেশ জয় পাচ্ছে। দর্শকরা দেশের দূর-দূরান্ত থেকে কষ্ট করে ঢাকার মাঠে খেলা দেখতে আসলেও দেশ জিতলে তাদের সেই কষ্ট আনন্দে পরিণত হয়। শুধু তাই নয়, ক্রিকেটে বিশ্বকাপে খেলা বড় বড় দলগুলো আমাদের দেশের সঙ্গে খেলতে আসে তাই দর্শকদের উপস্থিতি থাকে সন্তোষজনক’।
আর এই ক্ষেত্রে তিনি উদারহরণ হিসেবে টানলেন ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত আর্জেন্টিনা ও নাইজেরিয়ার মধ্যকার ম্যাচ। ‘আপনি দেখেছেলিনে দর্শকদের কী উপচেপড়া ভিড় ছিল?’
তাহলে কী করলে আমাদের ঢাকার মাঠে দর্শক ফিরবে? উত্তরে তিনি বললেন, আমাদের জাতীয় দলকে ভাল খেলতে হবে। খেলায় জয়-পরাজয় থাকবেই। তাই বলে টানা হারা যাবে না। জয়ের মানসিকতা তৈরি করতে হবে। একটি ম্যাচ হেরে গেলে হতাশ হওয়া যাবে না। পরের ম্যাচে জয়ের জন্য দলকে আরও উজ্জীবিত করতে হবে। তাদের একটি কথা মাথায় রাখতে হবে এদেশের কোটি মানুষ তাদের জয় দেখতেই অধীর আগ্রহে বসে থাকেন, পরাজয় দেখতে নয়।
তিনি আরো বলেন, পাশাপাশি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের ভবিষ্যত ট্যুর পরিকল্পনায় বিশ্বের বড় বড় দলগুলোর সঙ্গে দেশের মাটিতে বেশি আন্তর্জাতিক প্রীতি মাচের আয়োজন করতে হবে। তবেই প্রাণ ফিরে পাবে এদেশের ফুটবল এবং কান্নার রোল কাটিয়ে সহাস্যে মেতে উঠবে ঢাকার গ্যালারি।
এই কোচের মতের সূত্র ধরে ও দেশের ফুটবলমোদীদের দাবি অনুযায়ী বলাই যায়, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামসহ দেশের অন্যান্য ফুটবল স্টেডিয়ামগুলোর গ্যালারির এমন কান্না থামানোর গুরুদায়িত্ব এদেশের ফুটবলারদের, সেইসঙ্গে ফুটবল ফেডারেশনেরও। তারা কী পারবেন অবিরত এই কান্নার রোল থামিয়ে বঙ্গবন্ধু গ্যালারির বুকে অনাবিল আনন্দের জোয়ার বইয়ে দিতে, হাসি ফোটাতে? সে প্রশ্ন ফুটবল দর্শকসহ দেশের তাবৎ ক্রীড়ামোদীদের।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১৬
আইএ/এসআর