আশুলিয়া (ঢাকা) থেকে ফিরে: এমন আহামরি ব্যবসা-বাণিজ্য বা সম্পদ নেই তার। চলা-ফেরাও সাদাসিধে।
সেই জমিতে এখন শিমুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয়। নিজের জমি সরকারকে দান করে সৃষ্টি করলেন অনুপম এক উদাহরণের।
সাভার উপজেলার আশুলিয়ার জিরানি-শিমুলিয়া বাজার রাস্তার পাশে তেত্রিশ শতাংশ জমিটির বাজার মূ্ল্য দেড় কোটি টাকার ওপরে।
শুধু জমি দানই নয়, জনসেবায় দিন-রাত ছুটে চলা তার। সেবার মাধ্যমে মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিবেদিত করাটাই তার ব্রত আর আদর্শ। এভাবেই আমৃত্যু নিজেকে নিয়োজিত করতে চান তিনি।
তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা এ বি এম আজাহারুল ইসলাম সুরুজ। ১নং শিমুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান।
জনসেবায় মহৎ সব উদাহরণ সৃষ্টির জন্যে সাফল্যের ঝুড়িতে এসেছে শ্রেষ্ঠ চেয়ারম্যানের গৌরব। পেয়েছেন সমাজসেবায় বেশ কয়েকটি স্বর্ণপদক।
‘ভাই আমার এলাকাকে বিশ্ব চেনে। কিভাবে জানেন? বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে। সেই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমি। এই বিকেএসপিই তো সাকিব আল হাসানকে উপহার দিয়েছে। আমাদের মাটিতেই তো বাংলাদেশের গৌরবময় এই প্রতিষ্ঠান’- বাংলানিউজের কাছে এভাবেই নিজের এলাকার পরিচিতি তুলে ধরেন এ বি এম আজাহারুল ইসলাম সুরুজ।
তিনি বলেন, ‘প্রদীপের নিচে অন্ধকারের মতোই আমার এলাকা ছিলো অনুন্নত। ধরেন, বাইদগাঁও নামের একটি গ্রামের কথা। সেখান থেকে আমার ইউনিয়ন পরিষদ অর্থাৎ গোহাইলবাড়ি বাজারের পায়ে হাঁটা দূরত্ব মাত্র ৫ মিনিটের। কিন্তু সঠিক যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকায় এখানে গ্রামবাসীকে আসতে হতো কবিরপুর–জিরানি বাজার ঘুরে। সময় লাগতো এক থেকে দেড় ঘণ্টা’।
‘ওই এলাকার একটি মেয়ের সঙ্গে ঢাকার এক ছেলের সম্বন্ধ হলো। বিয়ের কথা পাকাপাকি। ছেলে তার হবু বউ দেখতে এলেন। দুর্গম যাতায়াত ব্যবস্থা দেখে ছেলে ও তার পরিবারের বেশ কিছু সদস্য বেঁকে বসলেন। একপর্যায়ে বিয়েই ভেঙে গেলো’।
‘রাস্তা না থাকার জন্যে একটি মেয়ের বিয়ে ভেঙে গেলো। সারা জীবনের জন্যে তার কষ্টের কারণ হলো একটিমাত্র রাস্তা। মেনে নিতে পারলাম না। দায় তো আমাদেরই’- আক্ষেপ এই জনপ্রতিনিধির।
তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমার মনে দাগ কাটলো। আমি মনে মনে স্থির করলাম, যে করেই হোক এ দুর্গম পথকে সহজ করতে হবে। রাস্তা আমাকে করতেই হবে। হালট, খাল, নালাসহ বহু মানুষের ফসলের ক্ষেত তখন পাহাড়ের মতো বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাস্তা সবার দরকার। কিন্তু অতো দামি জমি কে ছাড়তে চায়?’
‘কিন্তু আমার স্বপ্ন রাস্তা সেখানে হবেই। বহু বাধা আর আপত্তি উপেক্ষা করে রাস্তা করে ফেললাম। যাদের জমির ওপর দিয়ে রাস্তা গেলো, তারা আমার বিরোধিতা শুরু করলেন। তবে বেশিদূর এগোতে পারলেন না, রাস্তা হলো’।
‘বিশ্বাস করবেন না, রাস্তা যেদিন উদ্বোধন করলাম, সেদিন গ্রামের দেড়শ’র বেশি নারী আমাকে দুধ দিয়ে গোসল করালেন। বোঝেন তাদের অনুভূতি! সেদিন আমার দু’চোখ আবেগে ভেসে গেছে। সেই দুধের সঙ্গে গড়িয়ে গেছে আমার আনন্দ অশ্রু’।
‘আসলে মানুষের অনুভূতি বুঝতে হবে। আমি সেটাই চেষ্টা করছি মাত্র’- দৃঢ়কণ্ঠে বলছিলেন সুরুজ।
এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করছেন এ বি এম আজাহারুল ইসলাম সুরুজ। আগে ছিলেন ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার। গত ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান হিসেবে তাকে নির্বাচিত করেন এলাকার জনগণ।
শিমুলিয়া ইউনিয়নে নবীনগর–চন্দ্রা মহাসড়কের পাশে রয়েছে বেশকিছু শিল্প কারখানা। ইউপি চেয়ারম্যান সুরুজ সেখানকার শিল্প মালিকদের বলেছিলেন, ‘আপনারা আরো ভেতরে কারখানা স্থাপনে এগিয়ে আসুন’। তিনিও তাদের সহায়তা করেন। তারা গ্রামের পতিত ও অনুর্বর জমি কিনে সেখানে শিল্প কারখানা স্থাপন করেন। সেখানে এখন বহু মানুষের কর্মসংস্থানের ঠিকানা।
এভাবে সফল এই জনপ্রতিনিধির মহৎ উদ্যোগে শিল্পের চাকা বদলে দিয়েছে এলাকার মানুষের জীবনযাত্রাকে।
এখন ইউনিয়নের কোথাও কোনো হালট নেই। সবখানেই রাস্তা নির্মাণের মাধ্যমে এক গ্রামের সঙ্গে আরেক গ্রামের নিবিড় যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করে দিয়েছেন সুরুজ। এমনকি এলাকাটি প্রতিবেশি দু’টি উপজেলার সঙ্গে সহজ যাতায়াতের রাস্তাও খুলে দিয়েছে।
‘এগুলো কিন্তু এক অর্থে উন্নয়নের দিগন্ত উন্মোচন করেছে’- গর্বের সঙ্গে বলছিলেন ইউপি চেয়ারম্যান সুরুজ।
ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রামের ভেতরেই স্থাপিত হয়েছে ভারি শিল্প কারখানা, কলেজ, এমনকি ফিল্ম স্টুডিও। বেড়েছে এলাকার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ। তবে এলাকাটির গুরুত্বপূর্ণ জিরানি বাজার-গোহাইলবাড়ি–শিমুলিয়া সড়কের নাজুক অবস্থা যাতায়াতে বেকায়দায় ফেলেছে এলাকার মানুষকে।
সুরুজ বাংলানিউজকে বলেন, বহু চেষ্টার পর প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে রাস্তার টেন্ডার যখন চূড়ান্ত তখন ঠিকাদার পিছিয়ে গেলেন। বললেন, ‘এই প্রকল্পে কাজ নেওয়ার আগে প্রাক্কলন ব্যয়ের হিসেবের সঙ্গে বাস্তবের গড়মিল ছিলো’।
‘ঠিকাদার তার জামানতের টাকা ছেড়ে দিয়েই পিছটান দিলেন। বেড়ে গেলো আমাদের দুর্ভোগ। তবে আশার কথা, শিগগিরই পূর্ণ টেন্ডার হচ্ছে। তখন আমার এলাকায় উন্নয়নের গতি আরো বাড়বে’।
শিমুলিয়ার কলতাসুতি গ্রামের মৃত হাজী আজগর পালোয়ানের ৭ ছেলে, ১০ মেয়ের মধ্যে ‘সুরুজ চেয়ারম্যান’ নিজেকে জনসেবায় নিবেদনের মাধ্যমে সূর্যের মতো আলো ছড়িয়েছেন। এভাবে নামের মহিমার মতো জনসেবার সেই আলো ছড়িয়ে পড়ছে গ্রাম থেকে গ্রামে।
সুরুজের বাবা মরহুম হাজী আজগর পালোয়ান ছিলেন সম্ভ্রান্ত বংশের এবং তার বাবার একমাত্র ছেলে। মুক্তিযুদ্ধের পর হাজী আজগর বিকেএসপির পাশে বীরাঙ্গনাদের থাকার জন্যে ৬ বিঘা জমি দান করে দেন। আজ যার দাম ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকার বেশি।
‘কতোটা দেশকে ভালোবাসতেন তিনি। কতোটা দরদ ছিলো বীরাঙ্গনাদের প্রতি। ভাবলে শ্রদ্ধায় এখনো মাথা নুয়ে আসে। সেই হিসেবে বাবার রক্ত আমার ধমনিতে’- বলেন মহান বাবার গর্বিত ছেলে।
‘আমি তার ধারাবাহিকতায় ইউনিয়ন পরিষদের নামে ৩৩ শতাংশ জমি দান করলাম। জমিটির অর্ধেক মালিক আমার স্ত্রী তাহমিনা আক্তার। আমার স্ত্রীর বান্ধবীরাও অনেকে প্রতিষ্ঠিত। আমাদের মনে হলো, সারা জীবন তো আর চেয়ারম্যান থাকবো না। আমরা মারা যাওয়ার পরও কিন্তু থেকে যাবে এই ইউনিয়ন পরিষদ। যতোদিন থাকবে ততোদিন আমরা বেঁচে থাকবো জনগণের মাঝে। এ ভবনেই গড়ে উঠবে ইউনিয়ন পরিষদের আধুনিক কমপ্লেক্স। আমাদের এটাই আনন্দ। আসলে ভোগে না, ত্যাগে যে কি সুখ- তা প্রতি মুহূর্তে অনুভব করি আমি ও আমার স্ত্রী’।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সুরুজের বয়স সবে ১৪ বছর। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর খবর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতেন তিনি ও তার বন্ধুরা। শেষ পর্যায়ে সরাসরি যুদ্ধেও অংশ নেন। সঙ্গে থাকা ৫ সহযোদ্ধা শহীদ হলেন। গুরুতর আহত হলেন সোবহান ব্যাপারী নামের একজন। তিনি এখনো বেঁচে আছেন।
‘কখনো মুক্তিযোদ্ধা সনদ সংগ্রহ বা পরিচয় দিয়ে সুযোগ সুবিধে আদায়ের প্রয়োজন মনে করিনি। আসলে কোনো কিছু পাওয়ার আশায় তো সেদিন যুদ্ধ করিনি। চেয়েছিলাম, দেশ স্বাধীন করতে। দেশ স্বাধীন হয়েছে বলেই না আমি আজ চেয়ারম্যান হতে পেরেছি’- দেশপ্রেমিক সুরুজের বলিষ্ঠ উচ্চারণ।
১৯৮১ সালে সাভার অধর চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে রাজনীতিতে নাম লেখান এ বি এম আজাহারুল ইসলাম সুরুজ। ছিলেন শ্রমিক নেতা। এখন উপজেলা আওয়ামী লীগের শ্রম ও জনশক্তি বিষয়ক সম্পাদক।
স্থানীয় সংসদ সদস্য ডা. এনামুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, এ বি এম আজাহারুল ইসলাম ওরফে সুরুজ চেয়ারম্যান ইউনিয়ন পরিষদকে নিজের মূল্যবান জমি দান করে ত্যাগের যে মহিমা সৃষ্টি করেছেন, অন্যরা তা একটু অনুসরণ করলে বাংলাদেশের চেহারাটাই বদলে যেতো’।
‘সমাজের উল্টো স্রোতে জনপ্রতিনিধির সুনাম কিছুটা হলেও বাড়িয়েছেন তিনি। সুরুজ চেয়ারম্যান প্রমাণ করেছেন, পৃথিবীতে সবই ক্ষণস্থায়ী। আসলে ত্যাগটাই মানুষ মনে রাখে। এই ইউনিয়ন পরিষদ যতোদিন থাকবে, ততোদিন তার নামও থাকে। এর চেয়ে নিজেকে জনগণের মাঝে বাঁচিয়ে রাখার আর কিইবা বিকল্প হতে পারে?’
সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুল হাসান মোল্যা বাংলানিউজকে বলেন, ‘অনেকেই সরকারি জমি জাল কাগজপত্র বানিয়ে দখলে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এ বি এম আজাহারুল ইসলাম সুরুজ তার উল্টোটাই করলেন। সরকারের অনুকূলে ঢাকা জেলা প্রশাসকের নামে তিনি ও তার স্ত্রী জমিটি দান করেছেন ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়কে। আমরা এ উদ্যোগকে সন্মান ও শ্রদ্ধা জানাই। আমি দায়িত্বভার গ্রহণের পর বিষয়টি জেনেছি। তার জমিতেই ২০১৩ সালের ২২ এপ্রিল গড়ে ওঠে ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয়’।
জীবনের এতো সাফল্যের মাঝেও বেদনার বড় একটি ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন শ্রেষ্ঠ চেয়ারম্যানের পদকপ্রাপ্ত এ বি এম আজাহারুল ইসলাম সুরুজ। তার চার সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে ইব্রাহিম ১৪ বছর আগে স্কুলে গিয়ে আজো বাড়ি ফেরেনি। কোথায় যে আদরের ছেলেটি হারিয়ে গেলো, তা কেউ জানে না!
এখনো হারানো ছেলের পথ চেয়ে বসে থাকেন তিনি। এই বুঝি ছেলে ফিরে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলবে- ‘বাবা চিনতে পারছো! আমি তোমার হারানো ছেলে ইব্রাহিম’।
এসব ভেবে হাজারো কাজের মাঝে একান্তে নির্জনে চোখ দু’টো ভিজে আসে ছেলেকে হারিয়ে ফেলা এই বাবার।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১৬
জেডআর/এএসআর