ঢাকা: রাত আড়াইটা। শীতের মধ্যেও ক্লান্তিহীন নুপুর।
আগের পাঁচ বছর প্রতিদিন সকাল থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত চায়ের ফ্লাস্ক হাতে হেঁটে হেঁটে রাজপথেই কেটেছে তার। এখনও সেই রাজপথেই কাটছে তার দিন-রাত। এখন সেখানে শুধু যোগ হয়েছে একটি টং এর দোকান।
রাজধানীর জগন্নাথপুরের (নর্দা) রাজপথে ত্রিশোর্ধ নুপুরের প্রতিটি রাত কাটে নির্ঘুম। স্বামী সন্তানদের মুখে দু’মুঠো অন্ন তুলে দিতেই সারারাত জেগে ক্রেতাদের সেবা করতে হয় তাকে।
বৃহস্পতিবার (২৮ জানুয়ারি) দিনগত রাত আড়াইটার দিকে চায়ের কেটলি হাতে নুপুরের কাটে আরো একটি নির্ঘুম রাত। তার চায়ের কাপে ঠোঁট দিয়ে রাত জাগা নৈশ প্রহরী ফারুক শীতের তীব্রতা কাটাচ্ছেন রাত আড়াইটার সময়। আর চায়ের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন আরও কয়েকজন।
হঠাৎ একটি পুলিশ ভ্যান এসে থামে নুপুরে টং দোকানের পাশে। ভাটারা থানার টহল পুলিশের ওই ভ্যান থেকে নেমে আসেন একজন পুলিশ সদস্য।
ওই পুলিশ সদস্য তাকাতেই ছোট্ট ক্যাশ বাক্সে হাত চলে যায় নুপুরের। ২০ টাকা আর ১০ টাকার নোট মিলিয়ে ৫০ টাকা বের করে দেন পুলিশকে। টাকা পকেটে পুরে আস্তে করে পুলিশ সদস্য গিয়ে ওঠেন ভ্যানে।
পুলিশের নেওয়া ৫০ টাকার হিসাব জানতেই নুপুরের সঙ্গে আলাপচারিতা শুরু। তবে সংসারের অনেক কথা বললেও পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেননি নুপুর।
নুপুর জানান, ২ বছর ধরে প্রতি রাতেই ভ্যানের ওই টং দোকানে চা, সিগারেট, বিস্কুট, পওরুটি কলা নিয়ে পসরা সাজান তিনি। সারারাত চায়ের সঙ্গে এসব পণ্য বিক্রি করে পুরো সংসার চলে তার।
আট বছরে আগে পটুয়াখালী থেকে রাজধানীতে আসেন অভাবের কারণে। স্বামীর সঙ্গে থাকেন জগন্নাথপুরের একটি ভাড়া বাসায়। স্বামী আইয়ূব আলী বিশ্বাসসহ তিন সন্তান নিয়ে ৫ জনের সংসার তার।
স্বামীর খোঁজ নিয়ে জানা গেলো- পেশা বদলাতে পারেনি আইয়ূব আলী। পটুয়াখালীতে গ্রামে মানুষের ঘর তুলেই (ঘরামীর কাজ করে) ভালোই উপার্জন করতেন তিনি। কিন্তু ঢাকায় এসে সেই পেশায় কাজ করার সুযোগ নেই। এখন স্ত্রীর উপার্জনেই চলতে হয় তাকে।
দুই ছেলে এবং একটি মেয়ের লেখাপড়ার খরচ এবং স্বামীর হাত খরচসহ সব জোটাতে হয় নুপুরকে। তাই সাত বছর ধরেই চা বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন তিনি।
দুই বছর আগে একটি পুরাতন ভ্যান কিনে তার উপর চায়ের টং দোকান করেছেন নুপুর। তবে রাজধানীর এই ব্যস্ততম রাস্তায় দিনের বেলায় পসরা সাজিয়ে বসার কোনো সুযোগ নেই। রাত বেশি হলে রাস্তা-ঘাট প্রায় ফাঁকা হয়ে পড়ে। তখন রাস্তার এক পাশে ভ্যানের উপর দোকান সাজিয়ে সারারাত চা বিক্রি করেন তিনি।
বছরের কয়েকটা দিন ছাড়া পুরো বছর ধরে প্রতিটি রাতই জাগতে হয় তাকে।
এতে তার ক্লান্তি বা বিরক্ত আসে কিনা জানতে চাইলে নুপুর বলেন, অভ্যাস হয়ে গেছে। দিনে সকালের নাস্তা তৈরির পর এবং দুপুরের খাবার তৈরির আগে খাণিকটা ঘুমিয়ে নিলেই তার রাত জাগতে তেমন অসুবিধা হয়না।
নুপুর জানান, প্রতিরাতে রাতে বিক্রি হয় দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। তা থেকে যে লাভ আসে তা দিয়েই কোনো রকমে চলে যায় তাদের সংসার। ভাড়া বাসায় থেকে সন্তানদের লেখাপড়া করিয়ে আর কোনো টাকা জমা থাকে না।
নুপুর বলেন, আমার সন্তানরা একদিন উপার্জন করলেই আমার আর রাত জাগতে হবে না।
বাংলাদেশ সময় : ০৬১০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০১৫
এসএমএ/ওএইচ