ঢাকা: মায়ানামারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা সংকটকে রাজনৈতিক সমস্যা বলে অভিহিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে তিনি একথাও উল্লেখ করেছেন, সামরিক পন্থায় এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত আছেন। কেননা ’৭৫ এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তাকেও দীর্ঘ ছয়টি বছর প্রবাসে কাটাতে হয়। তৃতীয় পক্ষের সাহায্যে ছাড়া মায়ানামারকে স্থানীয় পর্যায়েই সমস্যাটির সমাধান করতে হবে।
তার আগে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মায়ানমার থেকে স্রোতের মতো রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ আসার সুযোগ দেওয়া হবে না। তবে এরই মধ্যে যারা সর্বহারা হয়ে চলে এসেছে, তাদের যথাসম্ভব সাহায্যে করা হচ্ছে।
রোহিঙ্গা সংকট সম্পর্কে ৩ ডিসেম্বর মায়ানমারের প্রধান রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি দাবি করেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে নেতিবাচক কথা বলছে। রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা মুসলিম ও বৌদ্ধদের মধ্যে সম্পর্ক ভালো নেই। মায়ানমারের জাতিগত জটিলতাকে বিবেচনায় নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও মায়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয়ভাবে রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবিলা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বিষয়টি সমাধানে আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। দ্বিপক্ষীয়ভাবেই এ সংকটের সমাধানের প্রক্রিয়া খোঁজা হচ্ছে । এটিকে আন্তর্জাতিক ফোরামে তোলার আগে দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে সর্বাত্মক চেষ্টা চলবে। ’
অভিবাসন সংস্থা আইওএম-এর ন্যাশনাল প্রোগাম অফিসার ও অভিবাসন ও উদ্বাস্তু বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় সবার আগে দরকার এটির একটি কূটনৈতিক সমাধান খোঁজা। শুধু বাংলাদেশ ও মায়ানমারের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক নয়, একটা আঞ্চলিক বৈঠকের আয়োজন করা যায় কিনা সে ব্যাপারে প্রস্তাব রাখা যেতে পারে। ’
তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন সম্প্রতি অত্যাচারিত হয়ে বেশ কিছু রোহিঙ্গা এরই মধ্যে বাংলাদেশে ঢুকেছে এবং আগামী এক মাসের মধ্যে আরো রোহিঙ্গা ঢুকতে পারে বলে আমার কাছে তথ্য রয়েছে। কারণ সেখানে অবস্থা এখনো পুরোপুরি শান্ত হয়নি। ’
মুনীর বলেন, ‘এটার জন্য একটা প্রস্তুতি থাকা দরকার। এ প্রস্তুতি হতে হবে যৌথ উদ্যোগে। জেলাপ্রশাসন, ইউএনও, এনজিও, রেডক্রিসেন্ট এবং মানবিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে। আসলে জরুরি দুর্যোগ মোকাবিলায় যেভাবে দেখা হয় সেভাবে এটির জন্য প্রস্তুতি নিয়ে এটিকে নিয়মের মধ্যে থেকে ডিল করতে হবে। ’
তিনি বলেন, ‘এরই মধ্যে যারা চলে এসেছে ভলান্টিয়ার দিয়ে নিরপেক্ষভাবে তাদের তালিকা তৈরি করা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কারণ এরপরে ভবিষ্যতে যদি তারা দেশের ভেতরে ছড়িয়ে যায়, তবে তাদের শনাক্ত করা দুরূহ হয়ে পড়বে। ছবি তুলতে না পারলেও নাম, ঠিকানা ও আসার দিনক্ষণ তুলে রাখা দরকার। এনজিওগুলোর কর্মীদের সাহায্যে এই কাজটা খুব সহজেই করা সম্ভব। ’
মুনীর বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের আসা বন্ধ করা কঠিন। যেসব রোহিঙ্গা জীবন বিপন্ন করে চলে আসবে তাদের বাসস্থান, খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ধরনের অবস্থা মোকাবেলার জন্য বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির খাবার মজুদ আছে। এখন দরকার সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সঙ্গে সমন্বয় করা। তবে ঢালাওভাবে ব্যানার দিয়ে ক্যামেরা ফোকাস করে এটি করা ঠিক হবে না। ’
তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গরা যে যেখানে আছে সেখানেই যেন থাকে তা নিশ্চিত করা দরকার। যদি তারা খাবার ও আশ্রয় না পায়, নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে তাহলে তারা বাংলাদেশের অন্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে। এই রোহিঙ্গাদের একটি জায়গায় রাখা এবং নিয়ম মেনে তাদের সহযোগিতা করা উচিৎ। ’
জেনেভায় জাতিসংঘে বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টচার্য বলেন, ‘এটা বাংলাদেশ-রোহিঙ্গা সমস্য নয়। বরং এটি মায়ানমার-মায়ানমার সমস্যা। যে কারণে এবং যেখানে এ সমস্যার উদ্ভব, সেখানে জোর দেওয়া সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যথেষ্ট পারিমাণে মায়ানমার সরকারের সঙ্গে আলোচনায় যুক্ত আছে কি-না সেটাই এখনো পরিষ্কার নয় এবং এ বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে মায়ানমারের সঙ্গে ভারত ও চীনের সুসম্পর্ক রয়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে এ সম্পর্ককে কাজে লাগাতে হবে। ’
তিনি আরও বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ বিষয়ে যুক্ত করা ছাড়া বাংলাদেশের মত স্বল্পোন্নত দেশের পক্ষে এমন জটিল সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশ-মায়ানমার বর্ডারে নয়, বরং সমাধান খুঁজতে হবে মায়ানমারের ভেতরেই। এখন যারা আসছে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষ ও সাহায্যদাতাদের প্রতি আহ্বান জানাই। ’
সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এনাম আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘আমার জানা মতে বহু বেশ কিছু বছর ধরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দ্বিপক্ষীয়ভাবে এটিকে সমাধান করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। কয়েকবার রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে দুপক্ষের মধ্যে সিদ্ধান্ত হওয়া সত্ত্বেও মায়ানমারের অসযোগিতায় তা ভেস্তে যায়। এখন রোহিঙ্গাদের এ দু:সহ জীবন নিয়ে বাংলাদেশের উচিত বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করা। এ বিষয়টি খুবই গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে করণীয় নির্ধারণ করে জাতিসংঘে উপস্থাপন করতে হবে। তাছাড়া ওআইসি’র মত মুসলিম সংস্থায় বাংলাদেশের যৌক্তিক অবস্থানকে জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে। এ ফোরামগুলোতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলতে হবে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানো হচ্ছে। তা বন্ধ কর। ’
তিনি আরো বলেন, ‘এছাড়াও মায়ানমারের নিকট দুই প্রতিবেশী মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াকে এ সংকট উত্তরণের প্রচেষ্টায় সংযুক্ত করা উচিত। বর্ডারে বাংলাদেশ যদি গুলি করা শুরু করে দেয় তাহলে আমাদের ইমেজের জন্য তা হবে ক্ষতিকর। সিরিয়ার রিফিউজি নিচ্ছে না বলে জার্মানি ও ইউরোপকে আমরা দোষারোপ করছি। এমন দোষ আমাদেরও আসবে। আসলে রোহিঙ্গাদের প্রতি মায়ানমারের অত্যাচার বন্ধ করতে হবে। এটি আমাদের প্রধান চেষ্টা হওয়া উচিৎ। মোদ্দা কথা, সমস্যা মোকাবেলায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সর্বশক্তি দিয়ে বিশ্বমঞ্চে জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো উচিৎ। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৮২৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০২১৬
কেজেড/জেএম