অর্ধেক জীবন পাড়ি দিয়া আইস্যা আইজ আমারে সেই পরিচয়ের সন্ধানই দিছে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি হাবিবুর রহমান স্যার- বাস্পরুদ্ধ কণ্ঠে বাংলানিউজকে এমনটাই বলছিলেন হিজড়া সোহাগী।
সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বিশেষ করে হিজড়াদের জীবনমান উন্নয়নে সাভারের হেমায়েতপুরে যাত্রা শুরু করেছে হিজড়াদের পরিচালনায় দ্বিতীয় বিউটি পার্লার।
পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি ও উত্তোরণ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমানের প্রচেষ্টায় হিজড়াদের জন্যে এটি দ্বিতীয় প্রয়াস। এর আগে আশুলিয়ায় পল্লী বিদ্যুৎ এলাকায় হিজড়া পরিচালিত দেশের প্রথম বিউটি পার্লারটিও যাত্রা শুরু করে তারই হাত ধরে।
নিজের সততাকে সঙ্গী করে সমাজের পরিবর্তন চান-এমন মানুষদের সম্মিলিত প্রয়াসে কেবল হিজড়াই নয়, সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে সাভার ও মুন্সীগঞ্জে বেদে সম্প্রদায়ের মানুষদের জীবনমান উন্নয়ন ও তাদের উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় এনে প্রশংসিত হয়েছেন পুলিশের এ কর্মকর্তা। এ ছাড়াও নিজের অবস্থানে থেকে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, পুলিশের স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি নিজ জেলা গোপালগঞ্জের চন্দ্রদিঘলিয়াতেও স্কুল, কলেজ, এতিমখানা, বেদে পল্লীতে স্কুল, মসজিদ, ঈদগাঁ, মাদ্রাসাসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান গড়ে হাবিবুর রহমান স্থাপন করেছেন দৃষ্টান্ত।
এভাবে সমাজ পরিবর্তনে দূত হিসেবেও অনেকের হৃদয়ে শ্রদ্ধার আসন গেড়েছেন এ পুলিশ কর্মকর্তা।
হিজড়া সোহাগী সাভারের বলিয়ারপুরের বাসিন্দা। বাবা সোহরাব হোসেন। শারীরিক গঠনের কারণে ছোটবেলা থেকেই বঞ্চনা আর অবহেলা তার নিত্যসঙ্গী। তা সত্ত্বেও ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। কিন্তু এ সমাজ বার বার বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তার জীবনে।
স্কুলে গেলেই নানা ধরনের টিপ্পনি আর তীর্যক মন্তব্য সইতে হতো। কষ্ট করে সমাপনী পাশ করে সবে মাত্র ক্লাস সিক্সে উঠছি, একদিন স্যার আইসা কইলো, তোমারে নিয়া তো হগগলতের (সকলের) সমস্যা। তুমি ক্লাসে না আইলেই ভালো হয়-সেদিন কানতে কানতে বাড়ি ফিরছিলাম। তারপর মাইয়া লোকের বেশ ধইরা রইলাম। আমার এক বোন আমারে বিউটি পার্লারের কাজ শিখনের ব্যবস্থা করলো। আমি ভালোভাবে কাজ শিখলাম। একদিন হিজড়া সুফিয়া আন্টি আমারে কইলো পুলিশের এক অফিসার আছেন, হাবিবুর রহমান। উনি নাকি আমাগো মতো মানুষের কষ্ট বুঝেন। তার কাছে যাইতে কাউরে ধরতে হয় না। সবার জন্যে নাকি হের দরজা খোলা। আমার জীবনের দুঃখের কথা শুইন্যা হাবিবুর রহমান স্যার কইলেন, তুমি যেহেতু বিউটিশিয়ানের কাজ জানো, তোমাকে বিউটি পার্লার করে দেবো। এ কথা শুইন্যা আমি তো অবাক। যেন মেঘ না চাইতেই জল! সব কিছু স্বপ্নের মতোন মনে হইতেছিলো।
আজ আমাগো সেই স্বপ্ন পূরণের দিন। এ বিউটি পার্লার আমিসহ চারজন হিজড়ার জীবন ধারণের পথ করে দিছেন।
কৃতজ্ঞতা ভরা কণ্ঠে এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে যাচ্ছিলেন সোহাগী।
সোহাগীদের স্বপ্ন যাত্রার সাক্ষী হতে শুক্রবার (২৬ জানুয়ারি) সাভারের হেমায়েতপুরে যেন বসেছিল হিজড়াদের মেলা। দূর দূরান্ত থেকে ববি, রশিদা, জীবনের মতো অনেকেই এসেছিলেন সেখানে। ঢাকার ধামরাই থেকে ছুটে আসা হিজড়া ইশা বাংলানিউজকে জানান, হিজড়াদের অনেকেই এসেছেন কেবলমাত্র হাবিব স্যারকে পা ছুঁয়ে সালাম করতে।
ইশা বলেন, তিনি আপনাদের কাছে হতে পারেন পুলিশের বড় কর্তা। কিন্তু আমাদের কাছে দেবতুল্য। পাশে থাকা শাম্মী নামে এক হিজড়াকে দেখিয়ে বললেন, দেখেন শাম্মীর জীবনটাও বদলে দিছেন হাবিব স্যার। আজ আশুলিয়ায় শাম্মীর মাধ্যমে মানুষ আমাদের সম্মানের চোখে দেখে।
হিজড়া সম্প্রদায়ের জন্যে জীবনমান উন্নয়নে আশুলিয়ার পল্লী বিদ্যুতে উত্তরণ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হিজড়া পরিচালিত দেশের প্রথম বিউটি পার্লারটি পরিচালিত হচ্ছে শাম্মীর নেতৃত্বে।
সেখানেও পরিশ্রমের মাধ্যমে গর্বের সঙ্গে মাথা উঁচু করে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করছেন বেশ কয়েকজন হিজড়া। আমরা পরিবর্তনের স্বপ্নটা দেখছি এভাবেই- বলছিলেন ইশা।
সমাজের অনগ্রসর এ জনগোষ্ঠীর একটি অংশের এ স্বপ্নযাত্রার ইতিহাসে নাম লেখাতে দেখা গেলো ঢাকা রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ-আল মামুন, অতিরিক্ত ডিআইজি (পার্সোনেল ম্যানেজমেন্ট) হাবিবুর রহমান, ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) শাহ মিজান শাফিউর রহমান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাইদুর রহমান, মাসুম আহমেদ ভূঁইয়া, গোলাম আজাদ খান, শরিফুল ইসলাম, সাভার সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খোরশেদ আলম, সাভার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মহসিনুল কাদির, আশুলিয়া থানার ওসি আব্দুল আউয়াল, গোয়েন্দা পুলিশের ওসি এএফএম সায়েদ, দীপক সাহা, আবুল বাশার, সাভার পৌরসভার মেয়র আব্দুল গণি ও তেতুলঝোঁড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফকরুল আলম সমরকে।
ঢাকা রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ-আল মামুন বাংলানিউজকে জানান, এ ধরনের কল্যাণমুখী প্রয়াস নিঃসন্দেহে প্রশংসার। যা পুলিশ বাহিনীকে আরো জনগণের কাছাকাছি নিয়ে আসে। কারণ পুলিশ মানেই যে জনগণের বন্ধু, তা অতিরিক্ত ডিআইজি হাবিবুর রহমান নিজের কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন।
জেলার পুলিশ সুপার শাহ মিজান শাফিউর রহমান বাংলানিউজকে জানান, আমার পূর্বসুরী হিসেবে ঢাকার পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্বপালন কালে হাবিবুর রহমান স্যার জনকল্যাণে যেসব উদ্যোগ নিয়েছিলেন তা দেশব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। নিজ নিজ অবস্থানে থেকেও কীভাবে সমাজ পরিবর্তন করা যায়, তার রোল মডেল হাবিবুর রহমান স্যার। আমরা তার সেইসব কাজকে এগিয়ে নিচ্ছি।
সাভার সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খোরশেদ আলম বাংলানিউজকে জানান, অতিরিক্ত ডিআইজি হাবিবুর রহমান স্যার পুলিশ বিভাগের রত্ন। আমাদের আইকন। একটি সময়ে বেদে ও হিজড়া সম্প্রদায়ের অনেকে এক সময় মাদকসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলো, তারা আজ আলোর পথের যাত্রী। এর নেপথ্য নায়ক হাবিবুর রহমান স্যারের প্রয়াস ‘উত্তোরণ’।
অতিরিক্ত ডিআইজি হাবিবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, সমাজের উন্নয়নের জন্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে হবে। তাদের নানাভাবে কর্মমুখি করে গড়ে তুলতে হবে। বিশেষ করে, বেদে ও হিজড়া সম্প্রদায় মানুষ হয়েও আজ মানুষের অধিকার থেকে বঞ্চিত। সঠিক দিকনির্দেশনা না পাওয়ায় তারা বিভিন্ন অপরামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। তাদের বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে এনে আলোর পথ দেখাতে বিভিন্ন ধরনের কর্মসংস্থান করাটাই জরুরি।
উত্তরণ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বেদেপল্লী ও হিজড়া সম্প্রদায়ের জন্য সেলাই প্রশিক্ষণ, বুটিক, কম্পিউটার ট্রেনিং, ফ্যাশন হাউস, বিউটি পার্লারসহ নানা ধরনের কর্মসংস্থানমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হচ্ছে। যা তাদের জীবনযাত্রা পাল্টে দিচ্ছে। তারা স্বাবলম্বী হচ্ছেন। অন্যদেরও পথ দেখাচ্ছেন। আমরা এমন বাংলাদেশই চেয়েছিলাম।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০১৮
এসআই